বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; মুফতী তাকী উসমানী লিখিত বই ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি সমস্যা ও সমাধান এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি জগৎসমূহের মালিক! দরূদ ও সালাম তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবার পরিজন, সাহাবায়ে কিরাম ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত যাঁরা নিষ্ঠার সাথে তাঁর অনুসরণ করবেন তাঁদের প্রতি।
বিগত কয়েক দশক যাবৎ মুসলমানগণ তাঁদের জীবনকে ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে নতুন করে বিনির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে! মুসলমানগণ প্রচন্ড ভাবে এ কথা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, বিগত কয়েক শতাব্দী যাবৎ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসন তাদেরকে বিশেষভাবে আর্থ-সামাজিক (Socio-Economic) ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-ব্যবস্থার উপর আমল করা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে! ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম জনগণ তাদের জীবনকে ইসলামী শিক্ষার আলোকে সাজানোর লক্ষ্যে নিজেদের ইসলামী স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক অঙ্গনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে শরীয়াহ মুতাবেক পরিচালনা করার লক্ষ্যে সেগুলোতে সংস্কার সাধন করা মুসলমানদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ! বিশেষত এমন এক পরিবেশে যার গোটা অর্থ ব্যবস্থা সুদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সে পরিবেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সূদ বিহীন (Interest – Free) ভিত্তির উপর পুনর্গঠন করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
যেসব লোক শরীয়তের মূলনীতি, আদর্শ এবং তার অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল নন, তারা কখনও কখনও মনে করে থাকেন যে! ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সুদমুক্ত করলে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থাকবে না! বরং সেগুলো সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপারিত রূপান্তরিত হয়ে যাবে! যার উদ্দেশ্য হবে বিনা লাভে আর্থিক সেবা (Financial Service) প্রদান করা।
প্রকৃতপক্ষে এ ধারণাটি সম্পূর্ণ প্রান্ত! শরীয়তের দৃষ্টিতে সুদবিহীন ঋণ একটি নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের জন্য; ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য নয়! বরং তা পারস্পারিক সহযোগিতা এবং কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য হয়ে থাকে! তবে যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুঁজি সরবরাহের (Commercial Financing) প্রশ্ন জড়িত! সেখানে ইসলামী শরীয়তের নিজস্ব এক স্বয়ংসম্পূর্ণ দিক নির্দেশনা (Set-up) বা নীতিমালা রয়েছে! সে ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হলো, যে ব্যক্তি অপরকে ঋণ প্রদান করছেন তাকে প্রথমে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তিনি কি এ ঋণ দ্বারা শুধু দ্বিতীয় পক্ষকে সাহায্য করতে চান, নাকি তার মুনাফায় অংশীদার হতে চান?
যদি তিনি এ ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাকে কেবল সাহায্য করতে চান তাহলে ঋণগ্রহীতা থেকে ঋণের পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত দাবী করা থেকে বিরত থাকতে হবে! তার মূল পুঁজি নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে (অর্থাৎ দ্বিতীয় পক্ষের ক্ষতি বা লোকসান হলেও ঋণদাতার মূলধন ফেরৎ পাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে)! কিন্তু মূল পুঁজির অতিরিক্ত কোন মুনাফার হকদার তিনি হবেন না! আর তিনি যদি অন্যকে এই উদ্দেশ্যে পুঁজি সরবরাহ করেন যে, তার ব্যবসায় অর্জিত মুনাফায় অংশ নিবেন এমতাবস্থায় তিনি অর্জিত মুনাফায় পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আনুপাতিক হারে মুনাফা দাবী করতে পারবেন! তবে, এ ক্ষেত্রে যদি লোকসান হয়ে যায় তাহলে তাকে উক্ত লোকসানেরও দায় বহন করতে হবে।
সুতরাং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সুদের পরিসমাপ্তির অর্থ এই নয় যে, পুঁজির যোগানদাতা (Financier) কোন মুনাফা অর্জন করতে পারবে না! বরং যদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে পুঁজির যোগান দেওয়া হয়, তাহলে লাভ- লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে! এ জন্যই ইসলামী বাণিজ্য আইনের শুরুতেই মুশারাকা এবং মুদারাবা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যে সকল ক্ষেত্রে কোনভাবেই মুশারাকা এবং মুদারাবা পদ্ধতিতে অর্থায়ন করা যায় না! সেসব ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য সমকালীন আলিমগণ অন্যান্য কিছু প্রক্রিয়াও উদ্ভাবন করেছেন! যেগুলো অর্থায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে! যেমন- মুরাবাহা, ইজারা, সালাম এবং ইসতিসনা।
বিগত দু’দশক যাবৎ ইসলামী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অর্থায়নের ইসলামী পদ্ধতিসমূহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে! তবে তা পরিপূর্ণভাবে সুদী অর্থায়নের বিকল্প নয়! আবার এ ধারনাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত যে, ইসলামী অর্থায়ন পদ্ধতিসমূহ হুবহু সুদী অর্থায়ন পদ্ধতির ন্যায় ব্যবহার করা যায়! বরং ইসলামী অর্থায়ন পদ্ধতিসমূহের রয়েছে নিজস্ব মূলনীতি, দর্শন এবং শর্তাবলী! যেগুলো ব্যতীত সে পদ্ধতিসমূহকে শরীয়তের দৃষ্টিতে অর্থায়ন পদ্ধতি (Modes of Financing) হিসেবে ব্যবহার করা বৈধ হবে না! সুতরাং এ পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে মৌলিক ধারণার অভাব এবং তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞতা ইসলামী অর্থায়নকে সুদভিত্তিক প্রচলিত অর্থায়নের সাথে খলত-মলত ও জগাখিচুড়ি করে ফেলার কারণ হয়ে যেতে পারে।
আমার বক্ষমান এ গ্রন্থটি বিভিন্ন বিষয় সম্বলিত! যার উদ্দেশ্য ইসলামী অর্থায়নের মূলনীতি এবং তার নিয়মাবলী সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দেয়া! বিশেষ করে অর্থায়নের যে পদ্ধতিসমূহ ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য নন ব্যাংকিং অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান (Non-Banking Financial Institutions)-এ ব্যবহৃত হচ্ছে সেসব অর্থায়ন পদ্ধতির গভীরে বিদ্যমান মূলনীতিসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী! এবং সেগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতিসমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করার প্রয়াস পেয়েছি! সাথে সাথে ঐ পদ্ধতিসমূহ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদ্ভুত বাস্তব সমস্যাবলী এবং শরীয়তের আলোকে সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধানের উপরও আলোকপাত করেছি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ডের সদস্য বা চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে আমার কাছে তাদের কর্মপদ্ধতি যথেষ্ট দুর্বল হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে! যার মৌলিক কারণ হল, শরীয়তের সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী সম্পর্কিত মূলনীতি ও নিয়ম- কানুন সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা! এ বাস্তব অভিজ্ঞতা বক্ষমান গ্রন্থটি পাঠকদের খেদমতে উপস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তার অনুভূতিকে শাণিত করেছে! গ্রন্থটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর উপর আমি সহজবোধ্য ও সাবলীলভাবে আলোকপাত করেছি যেন সাধারণ পাঠকবৃন্দ- যাদের ইসলামী অর্থায়নের নীতিমালা গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ হয়নি তারাও সহজে অনুধাবন করতে পারেন।
আশাকরি আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ইসলামী অর্থায়নের নীতিমালা এবং ইসলামী ব্যাংকিং ও প্রচলিত ব্যাংকিং-এর মধ্যকার পার্থক্য সহজভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে! পরিশেষে আল্লাহ তা’আলার দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন গ্রন্থটি কবুল করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের ওসীলা বানিয়ে দেন! এবং তা থেকে পাঠকমণ্ডলীকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করেন! ওয়ামা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ।