Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

হজ্জ করার নিয়ম ও হজ্জের দোয়া. Hajj er niyom Bangla

হজ্জ-করার-নিয়ম.-Hajj-er-niyom-Bangla

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে হজ্জ কত প্রকার কি কি এবং বিভিন্ন প্রকার হজ্জ করার নিয়ম ও হজ্জের দোয়া সমূহ।

হজ্জ কত প্রকার ও কি কি

হজ্জ তিন প্রকার। যথাঃ-

১. তামাত্তু

২. ক্বিরান

৩. ইফরাদ

এর মধ্যে তামাত্তু সর্বোত্তম। যদিও মুশরিকরা একে হজ্জের পবিত্রতা বিরোধী মনে করত এবং হীন কাজ ভাবতো।

১. হজ্জে তামাত্তু

হজ্জের মাসে ওমরার ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার সাঈ শেষে মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছেঁটে হালাল হওয়ার মাধ্যমে প্রথমে ওমরার কাজ সম্পন্ন করা। অতঃপর ৮ই জিলহজ্জ তারিখে স্বীয় অবস্থান স্থল হতে হজ্জের ইহরাম বেঁধে পূর্বাহ্নে মিনায় গমন করা। অতঃপর ৯ই জিলহজ্জ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান ও মুযদালিফায় রাত্রি যাপন শেষে ১০ই যিলহজ্জ সকালে মিনায় প্রত্যাবর্তন করে বড় জামরায় ৭টি কংকর মেরে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হওয়া। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘তাওয়াফে ইফাদা’ ও সাঈ শেষে পূর্ণ হালাল হওয়া। অতঃপর মিনায় ফিরে সেখানে অবস্থান করে ১১, ১২, ১৩ তিন দিন তিন জামরায় প্রতিদিন ৩×৭=২১ টি করে কংকর নিক্ষেপ শেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ সেরে হজ্জের কাজ সম্পন্ন করা।

উল্লেখ্য যে, তামাত্তু হজ্জ কেবলমাত্র হারাম বা মীকাতের বাইরের লোকদের জন্য, ভিতরকার লোকদের জন্য নয় (বাক্বারাহ ২/১৯৬)।

২. হজ্জে কিরান

এটি দু’ভাবে হতে পারে-

(ক) একই সাথে ওমরাহ ও হজ্জের ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতান ওয়া হাজ্জান বলে ইহরাম বাঁধা।

(খ) প্রথমে ওমরার ইহরাম বেঁধে অতঃপর ওমরার তাওয়াফ শুরুর পূর্বে হজ্জের নিয়ত ওমরার সঙ্গে শামিল করা।

এই হজ্জের নিয়ত কারীগণ প্রথমে উমরাহর কাজ শেষ করবেন অর্থাৎ তাওয়াফ ও সাঈ করবেন কিন্তু মাথা মুন্ডন করবেন না। এবং ইহরাম অবস্থায় থাকবেন। অতঃপর হজ্জের দিনগুলোতে হজ্জের কাজ সমাপ্ত করবেন। তবে প্রথম তাওয়াফের পর সাঈ করলে হজ্জের ফরজ তাওয়াফের পর সাঈ করতে হবে না। উল্লেখ্য যে, কিরান হজ্জে কুরবানী দেয়া ওয়াজিব।

বিদায় হজ্জে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে কিরান হজ্জ করেছিলেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে কুরবানী ছিল না, তাদেরকে তিনি তামাত্তু হজ্জ করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এখন যেটা বুঝছি সেটা আগে বুঝতে পারলে আমি কুরবানী সাথে আনতাম না। বরং তোমাদের সাথে ওমরাহ করে হালাল হয়ে যেতাম (অর্থাৎ তামাত্তু হজ্জ করতাম)।

মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫ ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।

যদি ক্বিরান হজ্জ কারীগণ তাওয়াফ ও সাঈ শেষে মাথার চুল ছেঁটে হালাল হয়ে যান, তবে সেটা ‘ওমরাহ’ হবে এবং তিনি তখন ‘তামাত্তু’ হজ্জ করবেন।

৩. হজ্জে ইফরাদ

শুধু হজের নিয়তে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা হাজ্জান’ বলে ইহরাম বাঁধা এবং যথারীতি তাওয়াফ ও সাঈ করার পর হজের আনুষ্ঠানিকতা সমূহ শেষ করা। তবে কিরান হজের মতো এই হজেও প্রথম তাওয়াফের পর সাঈ করলে হজ্জের ফরজ তাওয়াফের পর সাঈ করতে হবে না।

হজ্জে কিরান ও ইফরাদের একই নিয়ম। পার্থক্য শুধু এই যে, হজ্জে ক্বিরানে ‘হাই’ বা পশু কুরবানী প্রয়োজন হবে। কিন্তু হজ্জে ইফরাদে কুরবানীর প্রয়োজন নেই।

তামাত্তু হজ্জ করার নিয়ম

তামাত্তু হজ্জের দুটি অংশ। প্রথমটি হচ্ছে উমরাহ করা আর শেষটি হচ্ছে হজ্জ করা। উমরাহ এবং হজ্জ এই দুইটি কাজের সমন্বয়েই তামাত্তু হজ্জ। নিচে উমরাহ এবং হজ্জের পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হলোঃ-

উমরাহ করার নিয়ম

১. ইহরাম বাঁধা

২. তাওয়াফ করা

৩. সাফা-মারওয়া সাঈ করা

৪. মাথা মুণ্ডন করা অথবা সমস্ত মাথার চুল ছোট করা।

হজ্জের মাসে ওমরার ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার সাঈ শেষে মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছেঁটে হালাল হওয়ার মাধ্যমে প্রথমে ওমরার কাজ সম্পন্ন করা।

১. ইহরাম বাঁধা

বাংলাদেশী হাজীগণ সাধারণত তামাত্তু হজ্জ করে থাকেন। ঢাকা হতে জেদ্দা পৌঁছাতে বিমানে সাধারণত সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। তামাত্তু হাজীগণ জেদ্দা অবতরণের অন্তত আধা ঘন্টা পূর্বে বিমানের দেওয়া মীকাত বরাবর পৌঁছানোর ঘোষণা ও সবুজ সংকেত দানের পরপরই ওযু শেষে ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধবেন।

বাংলাদেশী হাজীগণ যদি মদীনা হয়ে মক্কায় যান, তাহলে মদীনায় নেমে যুল-হুলাইফা থেকে ইহরাম বাঁধবেন, তার আগে নয়। কেননা জেদ্দা হয়ে তিনি মদীনায় এসেছেন সাধারণ মুসাফির হিসাবে মসজিদে নববীতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে, হজ্জের উদ্দেশ্যে নয়। আর মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করা হজ্জের কোন অংশ নয়।

ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান

ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থানকে শরিয়তের ভাষায় মিকাত বলা হয়। পাঁচটি স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা যায়।

এক. জুল হুলায়ফা বা বীরে আলী: এটি মদিনাবাসী এবং মদিনা হয়ে মক্কায় প্রবেশকারীদের মিকাত।

দুই. ইয়ালামলাম: এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশকারীদের মিকাত।

তিন. আল-জুহফা: এটি সিরিয়া, মিসর ও সেদিক থেকে আগতদের মিকাত।

চার. কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবির: এটি নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত।

পাঁচ. যাতুল ইরক: এটি ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত।

ইহরামের সুন্নত

(১) ইহরামের পূর্বে অযু বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। তবে শর্ত নয়। মহিলাগণ নাপাক অবস্থায় ইহরাম বাঁধতে পারবেন।

(২) দেহে সুগন্ধি ব্যবহার করা, পোশাকে নয়।

(৩) পুরুষদের জন্য সাদা সেলাইবিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করা। মহিলাদের জন্য যে কোন ধরনের শালীন পোষাক পরিধান করা, যা পুরুষদের পোশাকের সদৃশ নয়।

যে কোন ফরয সালাতের পর কিংবা ‘তাহিয়্যাতুল অজু’ দুই রাকাত নফল সালাতের পর ইহরাম বাঁধা চলে। তবে ইহরাম বাঁধার সাথে সালাতের কোন সম্পর্ক নেই।

শায়খ আবদুল্লাহ বিন জাসের, আহকামুল হজ্জ (রিয়াদ: ৩য় সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ৭০-৭৫।

ইহরাম বাঁধার দোয়া

নিম্নোক্ত যে কোন একটি দোয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বাঁধতে হবে।

(১) লাব্বায়েক উমরাতান (আমি ওমরাহর জন্য হাজির)।

(২) লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতান। (হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাজির)।

(৩) লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতাম মুতামাত্তিআন বিহা ইলাল হাজ্জি; ফাইয়াসসিরহা লি ওয়া তাক্বাব্বালহা মিন্নী (হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাজির, হজের উদ্দেশ্যে উপকার লাভকারী হিসেবে। অতএব তুমি আমার জন্য ওমরাহকে সহজ করে দাও এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করে নাও)।

# যারা একই ইহরামে ওমরাহ ও হজ্জ দুটিই করবেন, তারা বলবেন, লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতান ওয়া হাজ্জান।

## যারা কেবলমাত্র হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন, তারা বলবেন লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা হাজ্জান।

### কিন্তু যারা পথিমধ্যে অসুখের জন্য বা অন্য কোন কারণে হজ্জ আদায় করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা করবেন, তারা ‘লাব্বায়েক উমরাতান’ অথবা ‘লাব্বায়েক হাজ্জান’ বলার পর শর্তাধীন দোয়া পড়বেন, ফাইন হাবাসানী হা-বিসুন, ফা মাহাল্লী হাইছু হাবাসতানী। অর্থ: যদি (আমার হজ্জ বা ওমরাহ পালনে) কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে যেখানে তুমি আমাকে বাধা দিবে (হে আল্লাহ!), সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১১)।

#### যারা কারু পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ করবেন, তারা তাদের মুওয়াক্কিল পুরুষ হলে মনে মনে তার নিয়ত করে বলবেন, লাব্বায়েক আন ফুলান (অমুকের পক্ষ হতে আমি হাজির)। আর মহিলা হলে বলবেন, লাব্বায়েক আন ফুলা-নাহ। যদি আন ফুলান বা ফুলা-নাহ বলতে ভুলে যান, তাতেও অসুবিধা নেই। নিয়তের উপরেই আমল কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।

##### সঙ্গে নাবালক ছেলে বা মেয়ে থাকলে (তাদেরকে ওযু করিয়ে ইহরাম বাঁধিয়ে) তাদের পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবক মনে মনে তাদের নিয়ত করে উপরোক্ত দোয়া পড়বেন। (ক্বাহত্বানী, পৃঃ ৫২-৫৫)।

ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ

হজ্জ ও ওমরার ইহরাম সালাতে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায়। ফলে ইহরাম বাধার পর মুহরিমের জন্য অনেকগুলি বিষয় নিষিদ্ধ থাকে। যেমন,

(১) সুগন্ধি ব্যবহার করা।

(২) স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মাথার চুল এবং যে কোন উপায়ে শরীরের যে কোন স্থানের পশম উঠানো ও হাত পায়ের নখ কাটা।

(৩) পশু-পক্ষী বা যেকোন প্রাণী শিকার করা। এমনকি শিকার ধরতে ইশারা-ইঙ্গিতে সহযোগিতা করা। তবে ক্ষতিকর জীবজন্তু যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইদুর, ক্ষ্যাপা কুকুর, মশা, উকুন ইত্যাদি মারার অনুমতি রয়েছে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৯৮-৯৯)।

(৪) যাবতীয় যৌনাচার, বিবাহের প্রস্তাব, বিবাহের আকদ বা যৌন আলোচনা করা।

(৫) পুরুষের জন্য পাগড়ি, টুপী ও রুমাল ব্যবহার করা। তবে প্রচণ্ড গরমে ছায়ার জন্য বা বৃষ্টিতে ছাতা বা ঐরূপ কিছু ব্যবহার করায় দোষ নেই।

(৬) পুরুষের জন্য কোন প্রকার সেলাই করা কাপড় যেমন জুব্বা, পাঞ্জাবী, শার্ট, গেঞ্জি, মোজা ইত্যাদি পরিধান করা। তবে তালি লাগানো ইহরামের কাপড় পরায় দোষ নেই।

(৭) মহিলাদের জন্য মুখাচ্ছাদন ও হাত মোজা ব্যবহার করা। তবে পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব।

(৮) ঝগড়া-বিবাদ করা এবং শরীআত বিরোধী কোন বাজে কথা বলা ও বাজে কাজ করা।

উপরোক্ত কাজগুলির মধ্যে কেবল যৌন মিলনের ফলে ইহরাম বাতিল হবে। বাকি গুলোর জন্য ইহরাম বাতিল হবে না। তবে ফিদিয়া ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ কাফফারা স্বরূপ একটি বকরী কুরবানী দিবেন অথবা ৬ জন মিসকীনকে তিন ছা খাদ্য দিবেন অথবা তিন দিন সিয়াম পালন করবেন।

মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৮৮।

অবশ্য যদি ভুলে কিংবা অজ্ঞতাবশত কিংবা বাধ্যগত কারণে অথবা ঘুম অবস্থায় কেউ করে ফেলে, তাতে কোন গুনাহ নেই বা ফিদিয়া নেই।

উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয় সমূহের উদ্দেশ্য হল মুহরিমকে দুনিয়াবি সাজসজ্জা থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি আল্লাহ মুখী করা। পুরুষের জন্য সেলাই বিহীন কাপড় পরিধানের উদ্দেশ্য হল সকল জৌলুস ও প্রদর্শনী থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য খালেছ ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।

তালবিয়াহ

ইহরাম বাধার পর থেকে মসজিদুল হারামে পৌঁছা পর্যন্ত ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ বস্তু সমূহ হতে বিরত থাকবেন এবং হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বদা সরবে নিম্নোক্ত দোয়া পড়বেন, যাকে ‘তালবিয়া’ বলা হয়। পুরুষগণ সরবে ও মহিলাগণ নিম্নস্বরে ‘তালবিয়া’ পাঠ করবেন।

মুয়াত্তা, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/২৫৪৯।

উচ্চারণ: ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক; ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক; লা শারীকা লাক’।

অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই।

উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগে আরবরা তাওয়াফ কালে নিম্নোক্ত শিরকী তালবিয়া পাঠ করত। – লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা, ইল্লা শারীকান হুয়া লাক; তামলিকুহু ওয়া মা মালাক’ (আমি হাজির তোমার কোনো শরিক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং যা কিছুর সে মালিক’)। মুশরিকরা ‘লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা’ বলার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো, আর বেড়োনা) বলতেন।

মুসলিম, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে; মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়া’ অনুচ্ছেদ।

বস্তুত: ইসলাম এসে উক্ত শিরকী তালবিয়া পরিবর্তন করে পূর্বে বর্ণিত নির্ভেজাল তাওহীদ ভিত্তিক তালবিয়া প্ৰবৰ্তন করে। যার অতিরিক্ত কোন শব্দ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেননি।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৪১ ‘ইহরাম ও তালবিয়া’ অনুচ্ছেদ।

‘তালবিয়া’ পাঠ শেষে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত কামনা করে এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ছহীহ হাদীছে বর্ণিত দো’আ সমূহ পাঠ করা যাবে। যেমন ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাহ, ওয়া আ’উযু বিকা মিনান্নার’ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে জান্নাত প্রার্থনা করছি ও জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি)।

আবু দাউদ হা/৭৯৩; সহীহ ইবনে হিব্বান হা/৮৬৫।

অথবা বলবে ‘রব্বে ক্বিনী ‘আযা-বাকা ইয়াওমা তাব আছু ‘ইবা-দাকা’। ‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার আযাব হতে আমাকে বাঁচাও! যেদিন তোমার বান্দাদের তুমি পুনরুত্থান ঘটাবে।

মুসলিম, মিশকাত হা/৯৪৭ তাশাহুদে দোয়া’ অনুচ্ছেদ-১৭।

নিয়তঃ মনে মনে ওমরাহ বা হজ্জের সংকল্প করা ও তালবিয়া পাঠ করাই যথেষ্ট। মুখে ‘নাওয়াইতুল ওমরাতা’ বা ‘নাওয়াইতুল হাজ্জা’ বলা বিদআত।

ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৬৪ পৃঃ।

উল্লেখ্য যে, হজ্জ বা ওমরার জন্য ‘তালবিয়া’ পাঠ করা ব্যতীত অন্য কোন ইবাদতের জন্য মুখে নিয়ত পাঠের কোন দলিল নেই।

ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, “কোন মুসলমান যখন ‘তালবিয়া’ পাঠ করে, তখন তার ডানে-বামে, পূর্বে-পশ্চিমে তার ধ্বনির শেষ সীমা পর্যন্ত কংকর, গাছ ও মাটির ঢেলা সবকিছু তার সাথে ‘তালবিয়া’ পাঠ করে’।

তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৫৫০।

ত্বীবী বলেন, অর্থাৎ যমীনে যা কিছু আছে, সবই তার তালবিয়া সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।

যদি কেউ তালবিয়া পাঠ করতেও ভুলে যান, তাহলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইবেন এবং তালবিয়া পাঠ করবেন। এজন্য তাকে কোন ফিদিয়া দিতে হবে না।

মসজিদুল হারামে প্রবেশের দোয়া

কা’বা গৃহ দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র ইচ্ছা করলে দুহাত উঁচু করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে যেকোন দো’আ অথবা নিম্নোক্ত দো’আটি পড়তে পারেন, যা ওমর (রাঃ) পড়েছিলেন।

আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, ফা হাইয়্যিনা রাব্বানা বিস সালাম। (হে আল্লাহ! আপনি শান্তি, আপনার থেকেই শান্তি আসে, অতএব হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে শান্তির সাথে বাঁচিয়ে রাখুন!)।

বায়হাকী ৫/৭৩; আলবানী, মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল ‘উমরাহ পৃ ২০।

অতঃপর মসজিদুল হারামে প্রবেশ করার সময় প্রথমে ডান পা রেখে নিম্নের দোয়াটি পড়বেন।

আল্লা-হুম্মা ছাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লাহুম্মাফতাহলী আবওয়াবা রহমাতিকা’ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর। হে আল্লাহ তুমি আমার জন্য তোমার অনুগ্রহের দরজাসমূহ খুলে দাও!’)।

হাকেম ১/২১৮; আবুদাউদ হা/৪৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৭৭২-৭৩; ছহীহাহ হা/২৪৭৮।

অথবা বলবেন, আ’ঊযু বিল্লা-হিল ‘আযীম, ওয়া বিওয়াজ হিহিল কারীম, ওয়া বিসুলত্বা-নিহিল ক্বাদীমি মিনাশ শায়ত্বা-নির রাজীম’ (‘আমি মহীয়ান ও গরিয়ান আল্লাহ এবং তাঁর মহান চেহারা ও চিরন্তন কর্তৃত্বের আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হতে’। এই দো’আ পাঠ করলে শয়তান বলে, লোকটি সারা দিন আমার থেকে নিরাপদ হয়ে গেল।

আবু দাউদ হা/৪৬৬; মিশকাত হা/৭৪৯।

দু’টি দো’আ একত্রে পড়ায় কোন দোষ নেই। বস্তুতঃ এ দো’আ মসজিদে নববী সহ যে কোন মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার দোয়া

প্রথমে বাম পা রেখে বলবেন, ‘আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিন ফাযলিকা’ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি’)।

অথবা বলবেন, ‘আল্লা-হুম্মা ছাল্লে ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া সাল্লেম; আল্লা-হুম্মা ছিমনী মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম’ (হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এর উপর অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে নিরাপদ রাখো’)।

ইবনু মাজাহ হা/৭৭৩; ছহীহাহ হা/২৪৭৮।

দু’টি দো’আ একত্রে পড়ায় কোন দোষ নেই। দো’আটি মসজিদে নববী সহ সকল মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২. তাওয়াফ করা

অতঃপর হাজারে আসওয়াদের নিকটবর্তী বনু শায়বা গেইট দিয়ে অথবা অন্য যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ওযু অবস্থায় সোজা মাতাফে গিয়ে কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) বরাবর সবুজ বাতির নীচ থেকে কাবা ঘরকে বামে রেখে তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) শুরু শুরু করবেন। একে ‘তাওয়াফে কুদুম’ বা আগমনী তাওয়াফ বলে।

উল্লেখ্য যে, বায়তুল্লাহ তাওয়াফ হল সালাতের মত। সেজন্য এতে পবিত্রতা শর্ত। মাঝখানে অযু ছুটে গেলে পুনরায় ওযু করে প্রথম থেকে আবার তাওয়াফ শুরু করতে হবে। না করলে বা সময় না পেলে তাকে ফিদিয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। তবে অজ্ঞতাবশত করলে মাফ। তাওয়াফের সময় ছালাতের ন্যায় চুপে চুপে দোআ পড়তে হয়। তবে এখানে বাধ্যগত অবস্থায় কল্যাণকর সামান্য কথা বলার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন।

তিরমিযী ও অন্যান্য; মিশকাত হা/২৫৭৬; ইরওয়া হা/১২১;

মনে রাখতে হবে যে, গৃহ প্রদক্ষিণ মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং আল্লাহর হুকুম মান্য করাই ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভই মুখ্য উদ্দেশ্য।

অতঃপর এই তাওয়াফের সময় পুরুষেরা ‘ইযত্বিবা’ করবেন। অর্থাৎ ডান বগলের নীচ দিয়ে ইহরামের কাপড় বাম কাঁধের উপরে উঠিয়ে রাখবেন ও ডান কাঁধ খোলা রাখবেন। তবে অন্যান্য তাওয়াফ যেমন তাওয়াফে ইফাদা, তাওয়াফে বিদা ইত্যাদির সময় এবং সালাতের সময় সহ অন্য সকল অবস্থায় মুহরিম তার উভয় কাঁধ ঢেকে রাখবেন। হাজরে আসওয়াদ থেকে প্রতিটি তাওয়াফ শুরু হবে ও সেখানে এসেই শেষ হবে।

তাওয়াফের শুরুতে ‘হাজরে আসওয়াদ’-এর দিকে হাত ইশারা করে বলবেন- ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি এবং আল্লাহ সবার বড়)। অথবা শুধু ‘আল্লাহু আকবর’ বলবেন।

বায়হাকী ৫/৭৯ পৃঃ।

এভাবে যখনই হাজারে আসওয়াদে পৌঁছবেন, তখনই হাত দ্বারা ইশারা অথবা চুমু দিয়ে আল্লাহু আকবর বলবেন। ভিড় কম থাকার সুযোগ নেই। তবুও সুযোগ পেলে তাওয়াফের শুরুতে এবং শেষে ‘হাজারে আসওয়াদ’ চুম্বন করার সুন্নাত আদায় করবেন।

মোট ৭টি তাওয়াফ হবে। প্রথম তিনটি তাওয়াফে ‘রমল’ বা একটু জোরে চলতে হবে এবং শেষের চার তাওয়াফে স্বাভাবিক গতিতে চলবেন। মহিলাগণ সর্বদা স্বাভাবিক গতিতে চলবেন।

মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৬৬।

অতঃপর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত ‘রুকনে ইয়ামানী’ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ‘হাজরে আসওয়াদ’ পর্যন্ত দক্ষিণ দেওয়াল এলাকায় পৌঁছে প্রতি তাওয়াফে এই দোয়া পড়বেন-

উচ্চারণ: রব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া কিনা আযা-বান্না-র।

অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যান দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা কর।

বাক্বারাহ ২/২০১; ছহীহ আবু দাঊদ হা/১৬৬৬; মিশকাত হা/২৫৮১; বুখারী হা/৪৫২২, ৬৩৮৯; মিশকাত হা/২৪৮৭।

এ সময় ডান হাত দিয়ে ‘রুকনে ইয়ামানী’ স্পর্শ করবেন ও বলবেন ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার’। তবে চুমু দিবেন না। ভিড়ের জন্য সম্ভব না হলে স্পৰ্শ করারও দরকার নেই বা ওদিকে ইশারা করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলারও প্রয়োজন নেই। কেবল ‘রব্বানা আ-তিনা… দো’আটি পড়ে চলে যাবেন। আনাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অধিকাংশ সময় অত্র দোয়াটি পাঠ করতেন। উল্লেখ্য যে, রব্বানা-এর স্থলে আল্লা- হুম্মা আ-তিনা কিংবা আল্লা-হুম্মা রব্বানা আ- তিনা বললে সিজদাতেও এ দো’আ পড়া যাবে। এতদ্ব্যতীত ছালাত, সাঈ, আরাফা, মুযদালিফা সর্বত্র সর্বদা এ দো’আ পড়া যাবে। এটি একটি সারগর্ভ ও সর্বাত্মক দোআ। যা সবকিছুকে শামিল করে এবং যা সর্বাবস্থায় পড়া যায়।

উল্লেখ্য যে, কাবার উত্তর পার্শ্বে স্বল্প উচ্চ দেওয়াল ঘেরা হাতীম এর বাহির দিয়ে তাওয়াফ করতে হবে। ভেতর দিয়ে গেলে ঐ তাওয়াফ বাতিল হবে ও পুনরায় আরেকটি তাওয়াফ করতে হবে। কেননা হাতীম অংশটি মূল ক’বার অন্তর্ভুক্ত। যাকে বাদ দিলে কাবা বাদ পড়ে যাবে।

এভাবে সাত তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে বা ভিড়ের কারণে অসম্ভব হলে হারাম শরীফের যে কোন স্থানে হালকাভাবে নীরবে দুই রাকাত নফল ছালাত ছালাত আদায় করবেন। এই সময় ডান কাঁধ ঢেকে নিবেন।

(ক) এই সালাত নিষিদ্ধ তিন সময়েও পড়া যাবে।

(খ) যদি বাধ্যগত কোন শারঈ কারণে বা ভুলবশতঃ এই ছালাত আদায় না করে কেউ বেরিয়ে আসেন, তাতে কোন দোষ হবে না। কারণ এটি ওয়াজিব নয়।

(গ) এখানে সুত্রা ছাড়াই ছালাত জায়েয। তবে মুসল্লিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। মুসল্লির সিজদার স্থান থেকে একটি বকরী যাওয়ার মত দুরত্বের বাহির দিয়ে অতিক্রম করা যাবে।

বুখারী হা/৪৯৬; মুসলিম হা/১১৩৪।

(ঘ) উক্ত সালাতে সূরা ফাতিহা শেষে প্রথম রাকাতে ‘সূরা কাফিরুন’ এবং দ্বিতীয় রাকাতে ‘সূরা ইখলাস’ পাঠ করবেন। তবে অন্য সূরাও পাঠ করতে পারেন।

তাওয়াফ ও সাঈ-তে সংখ্যা গণনায় কম হয়েছে বলে নিশ্চিত ধারণা হলে বাকিটা পূর্ণ করে নিবেন। ধারণা অনিশ্চিত হলে বা গণনায় বেশি হলে কোন দোষ নেই।

সালাত শেষে সম্ভব হলে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করবেন। অতঃপর নিকটেই পূর্ব-দক্ষিণে ‘যমযম’ এলাকায় প্রবেশ করে সেখান থেকে পানি পান করে পাশেই ‘সাফা’ পাহাড়ে উঠে যাবেন।

৩. সাফা-মারওয়া সাঈ করা

‘সাঈ’ অর্থ দৌড়ানো। তৃষ্ণার্ত মা হাজেরা শিশু ইসমাইলের ও নিজের পানি পানের জন্য মানুষের সন্ধানে পাগলপারা হয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে উঠে দেখতে চেয়েছিলেন কোন ব্যবসায়ী কাফেলার সন্ধান মেলে কি-না। সেই কষ্টকর ও করুণ স্মৃতি মনে রেখেই এ সাঈ করতে হয়।

সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার সাঈ (দৌড়) করবেন।

মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৫৭

দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী দুই সবুজ দাগের মধ্যে একটু জোরে দৌড়াবেন। তবে মহিলাগণ স্বাভাবিক গতিতে চলবেন। সাঈর সময় মহিলাদের দৌড়াতে হয় না সম্ভবতঃ তাদের পর্দার কারণে ও স্বাস্থ্যগত কারণে।

(১) সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হয়ে বলবেন, আমরা শুরু করছি সেখান থেকে যা দিয়ে আল্লাহ শুরু করেছেন। অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করবেন- ছাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ-ইরিল্লা-হ। অর্থ: নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। (বাক্বারাহ ২/১৫৮)।

(২) অতঃপর পাহাড়ে উঠার সময় তিনবার ‘আল্লা-হু আকবার’ বলবেন।

(৩) অতঃপর পাহাড়ে উঠে কা’বা-র দিকে মুখ করে দু’হাত উঠিয়ে তিনবার নিম্নের দো’আ পাঠ করবেন-

উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু, ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লে শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা শারীকা লাহূ, আনজাযা ওয়া দাহূ ওয়া নাসারা ‘আবদুহু, ওয়া হাযামাল আতা-বা ওয়াহদাহু’।

অর্থ: ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সকল রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সকল প্রশংসা। তিনিই বাঁচান ও তিনিই মারেন এবং তিনি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী’। ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন ও স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রু দলকে ধ্বংস করেছেন’। এই সাথে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করে অন্যান্য দো‘আও পড়া যাবে।

মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫; আবু দাউদ হা/১৮৭২।

(৪) সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত এক সাঈ, মারওয়া থেকে সাফা পর্যন্ত আরেক সাঈ। এমনি করে সাফা থেকে সাঈ শুরু হয়ে মারওয়াতে গিয়ে সপ্তম সাঈ শেষ হবে।

(৫) প্রতিবার সাফা ও মারওয়াতে উঠে কাবামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে পূর্বের দো’আটি পাঠ করবেন। তবে মারওয়াতে উঠে ‘ইন্নাছ ছাফা…’ আয়াতটি পড়তে হয় না।

(৬) তাওয়াফ ও সাঈ অবস্থায় নির্দিষ্ট কোন দো’আ নেই। বরং যার যা দো’আ মুখস্ত আছে, তাই নীরবে পড়বেন। অবশ্যই তা সহীহ হাদীছে বর্ণিত দো’আ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বান্দা তার প্রভুর নিকটে তার মনের সকল কথা নিবেদন করবেন। আল্লাহ তার বান্দার হৃদয়ের খবর রাখেন। ইবনে মাসউদ ও ইবনে উমর (রাঃ) এই সময় পড়েছেন : ‘রব্বিগফির ওয়ারহাম’ (হে প্রভু! আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর)।

বায়হাকী ৫/৯৫ পৃঃ।

(৭) এই সময় অধিকহারে ‘সুবহানাল্লাহ’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ পড়বেন বা কুরআন তেলাওয়াত করবেন।

# সাঈ-র জন্য ওযূ বা পবিত্রতা শর্ত নয়, তবে মুস্তাহাব। (ফাতাওয়া ইবনে বায ৫/২৬৪ পৃঃ)।

## সাঈ-র মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকী সাঈগুলি ট্রলিতে করায় দোষ নেই।

### তাওয়াফ ও সাঈ-র সময় একজন দলনেতা বই বের করে জোরে জোরে পড়তে থাকেন ও তার সাথীরা পিছে পিছে সরবে তা উচ্চারণ করতে থাকে। এ প্রথাটি বিদ’আত। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। অর্থ না বুঝে এভাবে সমস্বরে ও উচ্চৈঃস্বরে দোআ পাঠ করার মধ্যে যেমন খুশু-খুযূ থাকে না, তেমনি তা নিজ হৃদয়ে কোনরূপ রেখাপাত করে না। ফলে এভাবে তোতা পাখির বুলি আওড়ানোর মধ্যে কোনরূপ নেকী লাভ হবে না। উপরন্তু অন্যের নীরব দোআ ও খুশু-খুযূ-তে বিঘ্ন সৃষ্টি করার দায়ে নিঃসন্দেহে তাকে গুনাহগার হতে হবে।

#### তাওয়াফের পরেই সাঈ করার নিয়ম। কিন্তু যদি কেউ তাওয়াফে ইফাযার পূর্বেই অজ্ঞতাবশত বা ভুলক্রমে সাঈ করেন, তাতে কোন দোষ হবে না।

৪. মাথা মুণ্ডন করা অথবা সমস্ত মাথার চুল ছোট করা

সাঈ শেষ হওয়ার পর মাথার চুল ছোট বা মুণ্ডন করে নেবেন।

বিদায় হজের সময় তামাত্তু কারি সাহাবীগণ চুল ছোট করেছিলেন। হাদিসে এসেছে, অতঃপর সমস্ত মানুষ হালাল হয়ে গেল এবং তারা চুল ছোট করে নিল।

মুসলিম : ১২১৮।

সে হিসেবে তামাত্তু হাজীর জন্য ওমরার পর মাথার চুল ছোট করা উত্তম। যাতে হজের পর মাথার চুল কামানো যায়। মাথায় যদি একেবারেই চুল না থাকে তাহলে শুধু ক্ষুর চালাবেন। চুল ছোট করা বা মুণ্ডন করার পর গোসল করে স্বাভাবিক সেলাই করা কাপড় পরে নেবেন। ৮ জিলহজ পর্যন্ত হালাল অবস্থায় থাকবেন।

আর মহিলারা মাথার প্রতিটি চুলের অগ্রভাগ থেকে আঙ্গুলের কর পরিমাণ কর্তন করবেন; এর চেয়ে বেশি নয়।

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ৩/১৪৭।

উপরোক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে মুহরিমের উমরা পূর্ণ হয়ে যাবে। তিনি যদি তামাত্তু হজকারী বা স্বতন্ত্র উমরাকারী হন, তবে তার জন্য ইহরাম অবস্থায় যা নিষিদ্ধ ছিল তার সব হালাল হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যদি কিরান হজকারী হন, তাহলে এখন তিনি চুল ছোট বা মাথা মুণ্ডন করবেন না। বরং জিলহজের ১০ তারিখ (কুরবানীর দিন) পাথর মারার পর প্রথম হালাল না হওয়া পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকবেন।

এ সময়ে বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার, সালাত, সাদাকা, তাওয়াফ ইত্যাদি নেক কাজে নিয়োজিত থাকবেন। বিশেষ করে যিলহজের প্রথম দশ দিন, যেগুলোতে নেক কাজ করলে অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সওয়াব হাসিল হয়।

মহিলাদের জ্ঞাতব্য

(১) মহিলাগণ মাহরাম সঙ্গী ব্যতীত কোন গায়রে মাহরাম ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে হজ্জ বা ওমরা করতে পারবেন না।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫১৩, ২৫১৫।

মাহরাম হল রক্ত সম্পৰ্কীয় ৭ জন : (১) পিতা- দাদা (২) পুত্র-পৌত্র ও অধঃস্তন (৩) ভ্রাতা (৪) ভ্রাতুষ্পুত্র ও অধস্তন (৫) ভগিনী পুত্র ও অধস্তন (৬) চাচা (৭) মামু। এতদ্ব্যতীত দুগ্ধ সম্পৰ্কীয় গণ।

বিবাহ সম্পর্কীয় ৪ জন : (১) স্বামীর পুত্র বা পৌত্র (২) স্বামীর পিতা বা দাদা (৩) জামাতা, পৌত্র-জামাতা, নাতিন জামাতা (৪) মাতার স্বামী বা দাদী-নানীর স্বামী।

(২) ঋতুবতী ও নেফাস ওয়ালী মহিলাগণ তাওয়াফ (ও সালাত) ব্যতীত হজ্জ ও ওমরাহ সবকিছু পালন করবেন।

মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৭২

(৩) যদি ওমরাহর ইহরাম বাঁধার সময় বা পরে নাপাকী শুরু হয় এবং ৮ তারিখের পূর্বে পাক না হয়, তাহলে নিজ অবস্থানস্থল থেকেই হজ্জের ইহরাম বাঁধবেন এবং তিনি তখন ওমরাহ ও হজ্জ মিলিতভাবে কিরান হজ্জকারিনী হবেন।

(৪) পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাওয়াফ ব্যতীত সাঈ, ওকূফে আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনায় কংকর মারা, বিভিন্ন দো‘আ-দরূদ পড়া, কুরবানী করা, চুলের মাথা কাটা ইত্যাদি হজ্জের বাকী সব অনুষ্ঠান পালন করবেন।

(৫) নাপাক থাকলে বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়াই দেশে ফিরবেন।

হজের নিয়ম

১. ইহরাম বাঁধা

২. আরাফা ময়দানে অবস্থান করা

৩. মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা

৪. ১০ তারিখে জামরাতুল আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা

৫. মাথা মুণ্ডন করা অথবা সমস্ত মাথার চুল ছোট করা

৬. তাওয়াফে ইফাযাহ করা

৭. সাফা-মারওয়া সাঈ করা

৮. আইয়ামে তাশরীকের রাত্রিগুলি মিনায় অতিবাহিত করা

৯. ১১, ১২, ১৩ তারিখে তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা

১০. বিদায়ী তাওয়াফ করা।

৮ই জিলহজ্জ তারিখে স্বীয় অবস্থান স্থল হতে হজ্জের ইহরাম বেঁধে পূর্বাহ্নে মিনায় গমন করা। অতঃপর ৯ই জিলহজ্জ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান ও মুযদালিফায় রাত্রি যাপন শেষে ১০ই যিলহজ্জ সকালে মিনায় প্রত্যাবর্তন করে বড় জামরায় ৭টি কংকর মেরে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হওয়া। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘তাওয়াফে ইফাদা’ ও সাঈ শেষে পূর্ণ হালাল হওয়া। অতঃপর মিনায় ফিরে সেখানে অবস্থান করে ১১, ১২, ১৩ তিন দিন তিন জামরায় প্রতিদিন ৩×৭=২১ টি করে কংকর নিক্ষেপ শেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ সেরে হজ্জের কাজ সম্পন্ন করা।

১. ইহরাম বাঁধা

তামাত্তু হজ্জ পালনকারী গণ যিনি ইতিপূর্বে ওমরাহ পালন শেষে ইহরাম খুলে ফেলেছেন ও হালাল হয়ে গেছেন, তিনি ৮ই জিলহজ্জ সকালে স্বীয় অবস্থান স্থল হতে ওযূ-গোসল সেরে সুগন্ধি মেখে হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন ও নিম্নোক্ত দুআ পাঠ করবেন- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা হাজ্জান (হে আল্লাহ! আমি হজ্জের উদ্দেশ্যে তোমার দরবারে হাজির)।

মিনায় গমন

অতঃপর ‘তালবিয়া’ পাঠ করতে করতে কাবা থেকে থেকে প্রায় ৮ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন ও যোহরের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যাবেন।

অতঃপর মিনায় গিয়ে রাত্রি যাপন করবেন ও জমা না করে শুধু কসরের সাথে প্রতি ওয়াক্ত সালাত পৃথক পৃথকভাবে মসজিদে খায়েফে আদায় করবেন। তবে জামাতে ইমাম পূর্ণ পড়লে তিনিও পূর্ণ পড়বেন। ‘কসর’ অর্থ চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয সালাত গুলি দু’রাকা’আত পড়া। সফরে সুন্নত পড়ার প্রয়োজন নেই। এই সময় সিজদায় ও শেষ বৈঠকে ইচ্ছামত হৃদয় ঢেলে দিয়ে দো’আ করবেন। তবে রুকু ও সিজদায় কুরআনী দোয়া গুলো পড়বেন না।

উল্লেখ্য যে, মক্কার পরে মিনা হল হাজী সাহেবদের দ্বিতীয় আবাসস্থল। যেখানে তাঁদেরকে আরাফা ও মুযদালিফা সেরে এসে আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন কংকর মারার জন্য অবস্থান করতে হয়। ৯ তারিখে হজ্জ সেরে ১০ই যিলহজ্জ সকালে মিনায় ফিরে কংকর মেরে প্রাথমিক হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে।

২. আরাফা ময়দানে অবস্থান করা

৯ই জিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনা হতে ধীরস্থিরভাবে ‘তালবিয়া’ পাঠ করতে করতে ১৪.৪ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে আরাফা ময়দান অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং ময়দানের চিহ্নিত সীমানার মধ্যে সুবিধামত স্থানে অবস্থান নেবেন। যেখানে তিনি যোহর হতে মাগরিব পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাতে পৌঁছে সূর্য পশ্চিমে ঢললেই ইমামের সাথে এক আযান ও দুই ইকামতে কসর সহ ‘জমা তাকদীম’ করবেন। অর্থাৎ আছরের ছালাত এগিয়ে এনে যোহরের সাথে জমা করে কসর সহ ২+২=৪ রাক’আত ছালাত আদায় করবেন। কোন সুন্নাত পড়তে হবে না।

এখানে অবস্থানকালে সর্বদা দোয়া-দরুদ, তাসবিহ ও তেলাওয়াতে রত থাকবেন এবং কিবলামুখী হয়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে আল্লাহর নিকটে কায়মনো চিত্তে প্রার্থনায় রত থাকবেন, যেন আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত দাসদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আরাফার দিন আল্লাহ সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দান করে থাকেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন ও ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করে বলেন, দেখ ওরা কি চায়? (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিম্ন আকাশে নেমে আসেন ও ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা সাক্ষী থাকো আমি ওদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম।

রাযীন, বাযযার, ত্বাবারানী, সহীহ আত-তারগীব হা/১১৫৪-৫৫।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন শ্রেষ্ঠ দোআ হল আরাফার দোয়া।

তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৯৮; ছহীহাহ হা/১৫০৩।

আরাফার ময়দানে অবস্থান করে তওবা-ইস্তিগফার, যিকর ও তাসবীহ সহ আল্লাহর নিকটে হৃদয়-মন ঢেলে দো’আ করাটাই হল হজের মূল কাজ। এ সময় ছহীহ হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দো’আ পড়বেন ও কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকবেন।

সূর্য ঢলার পরে ইমাম বা তার প্রতিনিধি কর্তৃক হজ্জের সুন্নাতী খুতবা হয়ে থাকে। যা শোনা জরুরী ও আছরের ছালাত এক আযান ও দুই ইকামতে জমা ও কসর সহ আদায় করবেন। সম্ভব না হলে নিজেরা পৃথক জামাতে নিজ নিজ তাঁবুতে জমা ও কসর করবেন।

উল্লেখ্য যে, ৯ই জিলহজ্জ হাজীগণ সিয়াম পালন করবেন না। তবে যারা হাজী নন, তাদের জন্য আরাফার দিন সিয়াম পালন করা অত্যন্ত নেকীর কাজ। এতে বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়।

মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪।

এর দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানকারী মুসলিম নর-নারীগণ হজ্জের বিশ্ব সম্মেলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। যা মুসলিম ঐক্য ও সংহতির প্রতি গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

৯ই জিলহজ্জ পূর্বাহ্ন হতে ১০ই যিলহজ্জ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আরাফার ময়দানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই কিংবা ময়দানের উপর দিয়ে হজ্জের নিয়তে হেঁটে গেলেও আরাফায় অবস্থানের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।

অনেকে মসজিদে নামিরা বা তার সন্নিহিত এলাকায় অবস্থান করে সেখান থেকে মুজদালিফায় চলে যান। এতে তার হজ্জ বিনষ্ট হয় কেননা মসজিদে নামিরা আরাফা ময়দানের অন্তর্ভুক্ত নয়।

৩. মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা

৯ই জিলহজ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান হতে ‘তালবিয়া’ পাঠ ও তওবা-ইস্তিগফার করতে করতে ধীরে-সুস্থে প্রায় ৯ কি মি উত্তর-পশ্চিমে মুযদালিফা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের পূর্বে রওয়ানা হওয়া যাবে না। রওয়ানা দিলে পুনরায় ফিরে আসতে হবে ও সূর্যাস্তের পরে যাত্রা করতে হবে। যদি ফিরে না আসেন, তাহলে তার উপরে কাফফারা স্বরূপ একটি কুরবানী অর্থাৎ ফিদিয়া ওয়াজিব হবে। মুযদালিফায় পৌঁছে ‘জমা তাখির’ করবেন। অর্থাৎ মাগরিব পিছিয়ে এশার সাথে জমা করবেন। এক আযান ও দুই একামতে জমা ও কসর অর্থাৎ মাগরিব তিন রাক’আত ও এশার দু’রাকা’আত জমা করে পড়বেন। যরূরী কোন কারণে জমা ও কসরে বিরতি ঘটে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। দুই সালাতের মাঝে বা এশার সালাতের পরে আর কোন সালাত নেই। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলেন।

মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫।

এতে বুঝা যায় যে, তিনি এই রাতে বিতর বা তাহাজ্জুদ পড়েননি। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে ‘আল- মাশআরুল হারামে’ (অর্থাৎ মুযদালিফা মসজিদে) গিয়ে অথবা নিজ অবস্থানে বসে দীর্ঘক্ষণ কিবলামুখী হয়ে দুআ ইস্তিগফারে রত থাকবেন। তারপর ভালোভাবে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন।

দুর্বল ও মহিলাদের নিয়ে অর্ধরাত্রির পরেও রওয়ানা দেওয়া জায়েয আছে। তার পূর্বে রওয়ানা হওয়া জায়েয নয়। রওয়ানা দিলে ফিরে আসতে হবে। নইলে কাফফারা হিসাবে একটি কুরবানী ফিদিয়া দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, অর্ধরাত্রির পরে নিয়ত সহকারে মুযদালিফার উপর দিয়ে চলে গেলেও সেখানে অবস্থানের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুযদালিফা হতে মিনায় রওয়ানা হওয়ার সময় সেখান থেকে অথবা চলার পথে রাস্তার পাশ থেকে ছোলার চেয়ে একটু বড় সাতটি পাথর বা কংকর কুড়িয়ে নিবেন। যা মিনায় গিয়ে জামরাতুল আকাবা বা ‘বড় জামরায়’ মারার সময় ব্যবহার করবেন।

এ সময় বিশেষ ধরনের কংকর কুড়ানোর জন্য মুযদালিফা পাহাড়ে উঠে টর্চ লাইট মেরে লোকদের যে কঠিন প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়, সেটা স্রেফ বিদ’আতী আক্বীদার ফলশ্রুতি মাত্র। মুযদালিফায় গিয়ে মূল কাজ হল: মাগরিব-এশা একত্রে জমা করার পর ঘুমিয়ে যাওয়া। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে কিবলামুখী হয়ে কায়মনো চিত্তে দোয়ায় মশগুল হওয়া। রাতে এই বিশ্রামের কারণ যাতে পরদিন কুরবানী ও কংকর মারার কষ্ট সহজ হয়। আরাফা ময়দানের ন্যায় এখানেও কোন নির্দিষ্ট দোআ নেই।

মিনায় প্রত্যাবর্তন

১০ই যিলহজ্জ ফজরের সালাত আদায়ের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফা থেকে ‘তালবিয়া’ পাঠ করতে করতে মিনা অভিমূখে রওয়ানা হবেন। মুযদালিফার শেষ প্রান্ত ও মিনার সীমান্তবর্তী ‘মুহাসসির’ উপত্যকায় একটু জোরে চলবেন।

৪. ১০ তারিখে জামরাতুল আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা

অতঃপর প্রায় ৫ কি মি উত্তর-পশ্চিমে মিনায় পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর প্রথমে ‘জামরাতুল আকাবা’ যা মক্কার নিকটবর্তী, সেই বড় জামরাকে লক্ষ্য করে মক্কা বাম দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। এরপর থেকে ‘তালবিয়া’ পাঠ বন্ধ করবেন এবং ইহরাম খুলে হালাল হতে পারবেন, যদিও মাথা মুন্ডন ও কুরবানী বাকী থাকে। কোন কারণে পূর্বাহ্নে কংকর নিক্ষেপে ব্যর্থ হলে অপরাহ্নে কিংবা সূর্যাস্তের পূর্বে কংকর মারবেন। উল্লেখ্য যে, দুর্বল ও মহিলাগণ যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনায় পৌঁছেন, তাহলে তারা সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। অতঃপর কংকর মারবেন।

প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় ডান হাত উঁচু করে বলবেন, ‘আল্লা-হু আকবর’ ‘আল্লাহ সবার বড়’)। এভাবে সাতবার তাকবীর দিয়ে সাতটি কংকর মারবেন। এই তাকবীর ধ্বনি শয়তানের বিরুদ্ধে মুমিনের পক্ষ থেকে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং ঈদের তাকবীরের ন্যায় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কংকর হাউজে পড়লেই হবে। পিলারের গায়ে লাগা শর্ত নয়।

অতঃপর তাকবীর ধ্বনির সময় নিয়ত এটাই থাকবে যে, আমি আমার সার্বিক জীবনে শয়তান ও শয়তানী বিধানকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও আল্লাহর বিধানকে ঊর্ধ্বে রাখব। বস্তুতঃ হজ্জের পর থেকে আমৃত্যু তাগুতের বিরুদ্ধে আল্লাহর বিধানকে অগ্রাধিকার দেবার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারলেই হজ্জ সার্থক হবে ইনশাআল্লাহ।

কুরবানী

মিনায় পৌঁছেই দুপুরের আগে বা পরে যথাশীঘ্র কংকর মেরে কুরবানী করবেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে কুরবানী দেওয়ার ও পুত্রের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নেওয়ার অনন্য আত্মোৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত হতে প্রেরিত দুম্বার ‘মহান কুরবানীর পুণ্যময় স্মৃতিকে ধারণ করেই কুরবানী অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। যাতে মুসলমান সর্বদা দুনিয়াবী মহব্বতের উপরে আল্লাহ মহব্বতকে স্থান দিতে পারে। প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে এই দিনে এই মিনা প্রান্তরেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল।

(ক) কুরবানী তাই মিনা সহ ‘হারাম’ এলাকার মধ্যেই করতে হয়, বাইরে নয়। যদি কেউ হারাম এলাকার বাইরে আরাফাতের ময়দান বা অন্যত্র কুরবানী করেন, তবে তাকে হারামে এসে পুনরায় কুরবানি দিতে হবে। সামর্থ্য না থাকলে ফিদিয়া স্বরূপ হজ্জের মধ্যে ৩টি ও বাড়ী ফিরে ৭টি মোট ১০টি ছিয়াম পালন করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, কুরবানী মিনা ছাড়া মক্কায় এসেও করা যায়। কেননা মক্কা, মিনা, মুজদালিফা, আযীযিয়া সবই হারামের অন্তর্ভুক্ত। তবে আরাফাত নয়।

(খ) হাজী সাহেব সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে মিনার বাজার থেকে নিজের কুরবানীর পশু খরিদ করে কসাইখানায় জবাই করে গোশত কোটা বাছা করে নিয়ে আসতে পারেন।

কুরবানীর পশু সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। কুরবানী করার সময় উট হলে দাঁড়ানো অবস্থায় ‘হলকূমে’ অর্থাৎ কণ্ঠনালীর গোড়ায় অস্ত্রাঘাত করে রক্ত ছুটিয়ে দিবেন, যাকে ‘নহর’ করা বলা হয়। আর গরু বা দুম্বা-বকরি হলে দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে বাম কাতে ফেলে কিবলামুখী হয়ে তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়ে দ্রুত ‘জবেহ’ করবেন। তবে ক্বিবলামুখী হতে ভুলে গেলেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না। নহর বা জবেহ কালে নিম্নোক্ত দোয়া পড়বেন ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার; আল্লা-হুম্মা মিন্‌কা ওয়া লাকা, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নী’। অর্থ: ‘আল্লাহর নামে কুরবানী করছি। আল্লাহ সবার বড়। হে আল্লাহ! এটি তোমারই তরফ হতে প্রাপ্ত ও তোমারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হে আল্লাহ! তুমি এটা আমার পক্ষ থেকে কবুল কর’। অন্য কোন পুরুষের পক্ষ থেকে হ’লে বলবেন ‘মিন ফুলা-ন’ এবং মহিলার পক্ষ থেকে হলে বলবেন ‘মিন ফুলা-নাহ।

বায়হাকী ৯/২৮৬-৮৭।

জন প্রতি একটি করে বকরি বা দুম্বা ও সাত জনে মিলে একটি গরু অথবা সাত বা দশ জনে একটি উট কুরবানী দিতে পারেন।

মুসলিম ‘হজ্জ’ অধ্যায় হা/১৩১৮; মিশকাত হা/১৪৫৮; তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৬৯ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

মেয়েরাও যবেহ বা নহর করতে পারেন।

জানা আবশ্যক যে, নিজে কুরবানী করে পশুটিকে ফেলে রেখে আসা জায়েজ নয়। বরং এতে গুনাহগার হতে হবে। কেননা কুরবানীর পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবেহ করা হয় এবং তা অত্যন্ত সম্মানিত। অতএব তাকে যত্নের সাথে কোটা বাছা করতে হবে, নিজে খেতে হবে, অন্যকে দিতে হবে এবং ফকির-মিসকিনের মধ্যে অবশ্যই বিতরণ করতে হবে। নিজে না পারলে বিশ্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকে কোরবানি বাবদ নির্ধারিত টাকা জমা দিলে হাজী সাহেবের পক্ষে তারাই অর্থাৎ সৌদি সরকার উক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকার অনুমোদিত সংস্থা সমূহের লোকেরা উক্ত হাজীর নামে মিনা প্রান্তরেই সরকারি কসাইখানায় গিয়ে যবেহ বা নহর করে থাকে।

অতঃপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে ছাফ করে আস্ত বা টুকরো করে ফ্রিজে রেখে মোটা পলিথিনে মুড়িয়ে বিভিন্ন দেশে গরিবদের মাঝে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের সরকারের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অতএব মিনা প্রান্তরে মসজিদে খায়েফ-এর নিকটবর্তী সেলুন এলাকার সামনে বা অন্যত্র অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংক কাউন্টারে কুরবানী বা হাদই বাবদ নির্ধারিত ‘রিয়াল’ জমা দিয়ে রশিদ নিলেই কুরবানীর দায়িত্ব শেষ হলো বলে বুঝতে হবে। কুরবানী শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই।

(গ) কুরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য না থাকলে তার পরিবর্তে দশটি সিয়াম পালন করতে হবে। তিনটি হজ্জের মধ্যে (৯ই জিলহজ্জের পূর্বে অথবা ১০ই যিলহজ্জের পরে) এবং বাকী সাতটি বাড়ি ফিরে (বাক্বারাহ ২/১৯৬)। ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন ও পরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন সকলের জন্য সিয়াম পালন নিষিদ্ধ।

বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৮-৫০।

তবে ফিদিয়ার তিনটি সিয়াম এ তিন দিন রাখা যায়।

বুখারী হা/১৯৯৭-৯৮ আয়েশা ও ইবনু উমর (রাঃ) হতে।

(ঘ) উল্লেখ্য যে, ১০ই জিলহজ্জ তাকবীর সহ কংকর নিক্ষেপ করা ঈদুল আযহার তাকবীর ও সালাতের স্থলাভিষিক্ত। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের এদিন কংকর নিক্ষেপের পর সকলের উদ্দেশ্যে খুতবা দিয়েছেন। যেমন তিনি মদীনায় থাকা অবস্থায় ঈদের সালাতের পর খুতবা দিতেন। যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীন মিনাতে ঈদুল আজহার সালাত আদায় করেননি, সেহেতু তা আদায় করা হয় না।

(ঙ) তবে এ দিন বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ শেষে ঈদের তাকবীর ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহ আকবর, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু; আল্লা-হু আকবর, আল্লা-হু আকবর, ওয়া লিল্লা-হিল হামদ’ (আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়। নেই কোন উপাস্য আল্লাহ ব্যতীত। আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়, আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা’) বারবার পড়া উচিত।

৫. মাথা মুণ্ডন করা অথবা সমস্ত মাথার চুল ছোট করা

অতঃপর পুরুষগণ মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা সমস্ত চুল খাটো করে ছাঁটবেন। মহিলাগণ কেবল চুলের অগ্রভাগ সামান্য কেটে ফেলবেন। অতঃপর ইহরাম খুলে হালাল হয়ে যাবেন ও সাধারণ পোষাক পরিধান করবেন। তবে এটা হবে প্রাথমিক হালাল বা ‘তাহাল্লুলে আউয়াল’। এই হালালের ফলে স্ত্রী মিলন ব্যতীত সবকিছু সাধারণ অবস্থার ন্যায় করা যাবে।

৬. তাওয়াফে ইফাযাহ করা

এরপরই মক্কায় গিয়ে ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ করলে পুরো হালাল হওয়া যাবে। এ সময় ‘রমল’ করার প্রয়োজন নেই। ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’-কে ‘তাওয়াফে যিয়ারত’ও বলা হয়। এটি হজ্জের অন্যতম রুকন। যা না করলে হজ্জ বিনষ্ট হয়। সেকারণ রাত্রিতে হলেও ১০ই জিলহজ্জ তারিখেই এটা সম্পন্ন করা উচিত। নইলে আইয়ামে তাশরীকের মধ্যে অর্থাৎ ১১, ১২, ১৩ জিলহজের মধ্যে সম্পন্ন করা উত্তম। উল্লেখ্য যে, যিলহজ্জ মাসের পুরাটাই হজ্জের মাস সমূহের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ মাসের মধ্যেই তাওয়াফে ইফাযাহ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু যদি কোন কারণ বশতঃ এ মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তবে তার হজ্জ হয়ে যাবে। তবে একটি কুরবানী ফিদিয়া দিতে হবে। ঋতুর আশংকাকারী মহিলাগণ এ সময় ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে ঋতু রোধ করে ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ সেরে নিতে পারেন।

ফিকহুস সুন্নাহ ১/৫৩৭-৩৮

৭. সাফা-মারওয়া সাঈ করা

তামাত্তু হাজীগণ ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ সেরে সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন। অতঃপর পূর্ণ হালাল হবেন। কিন্তু কিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় পৌঁছে সাঈ সহ ‘তাওয়াফে কুদুম’ করে থাকলে শেষে তাওয়াফে ইফাযাহর পরে আর সাঈ করবেন না। ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে সেদিনই মিনায় ফিরে এসে রাত্রিযাপন করবেন।

৮. আইয়ামে তাশরীকের রাত্রিগুলি মিনায় অতিবাহিত করা

১১, ১২, ১৩ যিলহজ্জ আইয়ামে তাশরীক-এর তিন দিন মিনায় রাত্রিযাপন করা ওয়াজিব। এই সময় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে মসজিদে খায়েফে আদায় করা উত্তম। এ সময় কসর করা ও পূর্ণ পড়া দু’টিই জায়েয।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪৭।

ইমাম যেভাবে পড়েন, সেভাবেই পড়তে হবে।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৩৯।

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ সময় প্রতি রাতে কাবা জিয়ারত করতেন ও তাওয়াফ করে ফিরে আসতেন। প্রথম রাতে মিনায় থেকে শেষ রাতে মক্কায় যাওয়া যায়। মিনায় রাত্রি যাপন না করলে তাকে ফিদিয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। ৮ই জিলহজ্জ দুপুর হতে ১৩ জিলহজ মাগরিব পর্যন্ত গড়ে ৫ দিন মিনায় ও মুযদালিফায় অবস্থান করতে হয়। অবশ্য ১২ তারিখ সন্ধ্যার পূর্বেও মিনা থেকে মক্কায় ফিরে আসা জায়েজ আছে। অনেকে মিনায় না থেকে মক্কায় এসে রাত্রি যাপন করেন ও দিনের বেলায় মিনায় গিয়ে কংকর মারেন। বাধ্যগত শারঈ ওজর ব্যতীত এটি করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয।

যদি কেউ এটা করেন, তবে তাকে ফিদিয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে।

৯. ১১, ১২, ১৩ তারিখে তিন জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা

মিনায় ৪ দিনে মোট ৭০ টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১ম দিন ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন সকালে বড় জামরায় ৭টি। অতঃপর ১১, ১২, ১৩ যিলহজ্জ প্রতিদিন দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার পর হতে সন্ধ্যার মধ্যে তিনটি জামরায় ৩×৭=২১ টি করে মোট ৬৩টি। বাধ্যগত অবস্থায় রাতেও কংকর নিক্ষেপ করা যায়। ছোলার চাইতে একটু বড় যেকোন কংকর হলেই চলবে এবং তা যেখান থেকে খুশি কুড়িয়ে নেওয়া যায়। তবে ১০ তারিখে বড় জামরায় মারার জন্য প্রথম সাতটি কংকর মুযদালিফা থেকে বা মিনায় ফেরার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া মুস্তাহাব। ‘মুযদালিফা পাহাড় থেকে বিশেষ সাইজ ও গুণ সম্পন্ন কংকর সংগ্রহ করতে হবে’ বলে যে ধারণা প্রচার করা হয়ে থাকে, তা নিছক ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী মাত্র।

কংকর মারার আদব

(ক) প্রথমে ‘জামরা ছুগরা’ (ছোট) যা মসজিদে খায়ফের নিকটবর্তী, তারপর ‘উস্তা’ (মধ্যম) ও সবশেষে ‘কুবরা’ (বড়)-তে কংকর মারতে হবে। যদি কেউ সূর্য পশ্চিমে ঢলার পূর্বে কংকর মারে কিংবা নিয়মের ব্যতিক্রম করে আগে ‘বড়’ পরে ‘মধ্যম’ ও শেষে ‘ছোট’ জামরায় কংকর মারে, তবে তাকে ফিদিয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। পূর্ণ শালীনতা ও ভদ্রতার সাথে জামরার উঁচু পিলার বেষ্টিত হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে তার মধ্যে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রতিবারে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ডান হাত উঁচু করে সাতবারে সাতটি কংকর মারবেন। খেয়াল রাখতে হবে হাউজের মধ্যে পড়ল কি-না। নইলে পুনরায় মেরে সাতটি সংখ্যা পূরণ করতে হবে। কংকর গণনায় ভুল হলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দু’একটা পড়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে, তাতে কোন দোষ হবে না। কিন্তু সব গুলো হারিয়ে গেলে পুনরায় কংকর সংগ্রহ করে এনে মারতে হবে। নইলে ফিদিয়া দিতে হবে।

(খ) ছোট ও মধ্যম জামরায় কংকর মেরে প্রতিবারে একটু দূরে সরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর নিকট দো’আ করতে হয়। অতঃপর বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাঁড়াতে হয় না বা দো‘আও করতে হয় না।

(গ) এই সময় হুড়াহুড়ি করা, ঝগড়া করা, জোরে কথা বলা, কারো গায়ে আঘাত করা, জুতা-স্যাণ্ডেল নিক্ষেপ করা, কারু উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া, পা দাবানো ইত্যাদি কষ্টদায়ক যাবতীয় ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। শয়তান মারার নামে এগুলো আরেক ধরনের শয়তানী আমল মাত্র। হজের পবিত্র অনুষ্ঠান সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এগুলি পালন করতে এসে যাবতীয় বিদআত থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। নইলে হজ্জের নেকি থেকে মাহরুম হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে।

(ঘ) সক্ষম পুরুষ বা মহিলার পক্ষ হতে অন্যকে কংকর মারার দায়িত্ব দেওয়া জায়েয নয়। যার কংকর তাকেই মারতে হবে।

(ঙ) নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত অন্য সময়ে কংকর মারার কাযা আদায় করার নিয়ম নেই। তবে যদি কেউ শারঈ ওজর বশত সন্ধ্যার সময়সীমার মধ্যে কংকর মারতে ব্যর্থ হন, তাহলে বাধ্যগত অবস্থায় তিনি সূর্যাস্তের পর হতে ফজরের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কংকর মারতে পারেন।

(চ) বদলী হজ্জের জন্য কিংবা প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে দুর্বল, রোগী বা অপারগ মহিলা হাজীর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে প্রথমে নিজের জন্য সাতটি কংকর মারবেন। পরে দায়িত্ব দানকারী মুওয়াক্কিল-এর নিয়তে তার পক্ষে সাতটি কংকর মারবেন।

ছ) ১২ই জিলহজ্জ কংকর মারার পরে হজ্জের কাজ শেষ করতে চাইলে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। যদি রওয়ানা অবস্থায় ভিড়ের কারণে মিনাতেই সূর্য ডুবে যায়, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি রওয়ানা হবার পূর্বেই মিনাতে সূর্য অস্ত যায়, তাহলে থেকে যেতে হবে ও পরদিন দুপুরে সূর্য ঢলার পর আগের দিনের ন্যায় যথারীতি তিন জামরায় ২১টি কংকর মেরে রওয়ানা হতে হবে। ১২ তারিখ আগেভাগে চলে যাওয়ার চাইতে ১৩ তারিখে দেরি করে যাওয়াই উত্তম।

জ) বাধ্যগত শারঈ ওজর থাকলে প্রথম দুই দিনের স্থলে একদিনে কংকর মেরে মক্কায় ফেরা যাবে।

১০. বিদায়ী তাওয়াফ করা

ঋতুবতী ও নেফাস ওয়ালী মহিলা ব্যতীত কোন হাজী বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়া মক্কা ত্যাগ করতে পারবেন না।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৬৮।

যদি কেউ সেটা করেন, তাহলে তাকে ফিদিয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। অতএব মিনার ইবাদত সমূহ শেষ করে মক্কায় ফিরে এসে হাজীগণ বায়তুল্লাহতে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। এ সময় সাঈ করার প্রয়োজন নেই।

তবে যদি ইতিপূর্বে ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ না করে থাকেন, তাহলে তামাত্তু হাজীগণ ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ করে পূর্ণ হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। তখন তাকে আর বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে না। পক্ষান্তরে কিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় এসে তাওয়াফে কুদুম-এর সময় সাঈ করে থাকলে এখন আর সাঈ করতে হবে না। কেবল ‘তাওয়াফে ইফাযাহ’ করেই হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। অনুরূপভাবে ঋতুবতী বা নেফাস ওয়ালী মহিলাগণ বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়াই দেশে ফিরবেন।

বায়তুল্লাহ থেকে বেরিয়ে দেশে ফেরার সময় তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন। অতঃপর নিম্নোক্ত দোআ পড়বেন :

উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু; লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর; আ-য়িবূনা তা- ইবুনা ‘আ-বিদূনা সা-জিদূনা লি রব্বিনা হা- মিদূনা; ছাদাক্বাল্লা-হু ওয়া’দাহু ওয়া নাছারা ‘আবদাহু ওয়া হাযামাল আহযা-বা ওয়াহদাহু।

অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই সকল বস্তুর উপরে ক্ষমতাবান। আমরা সফর হ’তে প্রত্যাবর্তন করছি তওবাকারী হিসাবে, এবাদতকারী হিসাবে, সিজদাকারী হিসাবে এবং আমাদের প্রভুর জন্য প্রশংসাকারী হিসাবে। আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর প্রতিশ্রুতিকে, জয়ী করেছেন তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে এবং পরাজিত করেছেন একাই সম্মিলিত (কুফরী) শক্তিকে।

মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৪২৫।

Share the Post

Rate the Post

Rating Summary

0.0
0.0 out of 5 stars (based on 0 reviews)
Excellent0%
Very good0%
Average0%
Poor0%
Terrible0%

Latest Reviews

There are no reviews yet. Be the first one to write one.

Related posts

Latest Post

Scroll to Top