বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; ড. মুহাম্মাদ ইবরাহিম আশ শারিকি লিখিত বই ইসলামের ইতিহাস নববী যুগ থেকে বর্তমান এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
প্রতিটি জীবন্ত জাতি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানমূলক এবং ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে—যে-উপাদানসমূহ রচনা করে সেই জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও টিকে থাকার ভিত। তেমনিভাবে আরবদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো, যে-সব উপাদানের উপর ভিত্তি করে আরবজাতি বেড়ে উঠেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে এবং উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, সে-উপাদানগুলোর একমাত্র উৎস ছিলো ‘ইসলাম’: অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম অবলম্বনের পর থেকেই মূলত আরবজাতি ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ও মর্যাদাবান স্থান করে নিতে পেরেছে।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে আরবদের জন্মভূমি ‘আরব-উপদ্বীপ’-এ (জাযিরাতুল আরবে) ইসলাম ধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। ইসলাম এসে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজার বিনাশ সাধন করে এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে তাদের প্রতিমাগুলো। আর ইসলামই এই আরবদেরকে দেখায় পৌত্তলিকতার দাবানল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ। আরবদেরকে স্বগোত্র প্রীতি ও আঞ্চলিকতাবাদের প্রবণতা-মুক্ত করতে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। ইসলামের ছোঁয়াতেই এই আরব জাতির জ্ঞান-বুদ্ধি এবং আকল-মন আলোকমালার সন্ধান পায়। ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে তাদের তনু-মন। ফলে তারা ঝুঁকে পড়ে একমাত্র শরিকবিহীন (লা-শারিক) বিশ্ব প্রভু মহান আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার প্রতি।
আরবদের এই পরিবর্তনের কারণ—ইসলামই তাদেরকে এক নতুন অস্তিত্ব ও কাঠামো উপহার দিয়েছে এবং তাদেরকে এমন এক সমাজে একীভূত করেছে, যে- সমাজের নেতৃত্বে ছিল সংহতি, উদারতা, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ন্যায়পরায়নতার সমূহ অনুভূতি। পারস্পরিক সংহতি, সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ইনসাফের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো এই সমাজ। অথচ ইতোপূর্বে আরবরা ছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার ঘোর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এবং বিপথগামী একটি উপজাতি।
আমরা সবাই গর্বের সাথে স্মরণ করি, ১৪০০ বছর আগে আরবদের জন্মভূমিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ এর দাওয়াত ও আহ্বান প্রকাশ পেয়েছিলো! মুহাম্মাদের এই আহ্বান ছিলো পুরো মানবজাতির জন্য হেদায়াত ও পথনির্দেশ এবং বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি ঈমান আনয়ন ও বিশ্বাস- স্থাপনের আহ্বান! রাসূলে কারীমের এই ডাক ও আহ্বান ছিল সকল জাতিকে এক জাতিতে ঐক্যবদ্ধ করার! যাতে থাকবে না কোনো বংশগত ভেদাভেদ ও আঞ্চলিকতা প্রীতির ছাপ।
আমরা এ-কথা ভুলবো না যে, ইসলামধর্ম তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার কারণে বিশ্বের অন্যান্য ধর্ম থেকে শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রাধিকারের স্থান দখল করে আছে। এই ধর্ম যেমনিভাবে প্রভুর সাথে মানুষের সম্পর্ককে সুগঠিত ও মজবুত করে তোলে, তেমনি মানুষের সাথে মানুষের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককেও সুবিন্যস্ত ও প্রগাঢ় করে— একইভাবে ইসলাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কও সুসংহত করে।
ইসলামের আবেদন ও আইনের কারণে এই ধর্মকে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়! যা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বৈশিষ্ট্য এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সুরক্ষা বাধ্যতামূলক করে! দায়িত্বের ক্ষেত্রে অধিকার, কর্তব্য ও সংহতিতে জাতির নাগরিকদের মাঝে একতা রক্ষার আহ্বান করে! ইসলাম মানুষের মাঝে বংশ-গোত্র ও বর্ণপ্রথার বিভেদ দূর করে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য করে! এ-ব্যাপারে আমাদের জন্য রাসূলের সেই বাণীটি যথেষ্ট, যেখানে তিনি বলেন, “অনারবের ওপর আরবের এবং কৃষ্ণবর্ণের ওপর শ্বেত বর্ণের কোনো মর্যাদা নেই! তাকওয়াই মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি!” অর্থাৎ যে বেশি তাকওয়াবান (আল্লাহভীরু), সে বেশি সম্মান ও মর্যাদা পাবার হকদার! এ ছাড়া আরব-অনারব, সাদা চামড়া কালো চামড়ার মানুষ সকলেই সমমানের।
ইসলাম আমাদের বংশ ও জাত কৌলিন্য দূর করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও জিহাদের প্রতিও উৎসাহিত করেছে! ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ করা ও বাধা দেওয়া এবং মজলুম ও নির্যাতিতদের সাহায্য করার ব্যাপারেও অনুপ্রাণিত করেছে ইসলাম! এ-সব নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম সংঘটিত হওয়ায় ইসলামী দাওয়াতের পতাকাতলে বিভিন্ন জাতি, বংশ ও শ্রেণির মানুষ একীভূত হয়ে মিশে গেছে বৃহৎ ইসলামী সমাজে।
আরব উপদ্বীপ (জাজিরাতুল আরব) অঞ্চলে ইসলামী দাওয়াতের প্রচার-প্রসার এবং রাসূলের যুগে মদীনা মুনাওয়ারায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াতি মিশন জাযিরাতুল আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে খোলাফায়ে রাশিদার আমলে এই মিশন পূর্ণতা লাভ করে। ফলে ইরাক, বৃহত্তর শাম, ইরান, পারস্য এবং মিশর বিজিত হয়ে ইসলামের শাসনাধীনে চলে আসে। তৃতীয় পর্যায়ে উমাইয়াদের শাসনামলে (যারা সামেশককে খেলাফতের রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিলো) তুর্কিস্তান, মঙ্গোলিয়া, সিন্ধু প্রদেশ উত্তর-আফ্রিকা এবং আন্দালুস ইত্যাদি অঞ্চল বিজয় করা হয়। এই তৃতীয় পর্যায়ে (যার সময়কাল ছিল প্রায় ১ শতাব্দী) ইসলামি সাম্রাজ্য পূর্বে চীন- সীমান্ত থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক সাগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
ইসলামের ইতিহাসের চতুর্থ ধাপ শুরু হয় আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনকালে যোট ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল এবং ক্ষমতা ও বৈজ্ঞানিক- সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির সুউচ্চ মর্যাদায় পৌঁছেছিলো) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে! এই চতুর্থ ধাপের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় ৫২৫ বছর! আব্বাসীয়দের শাসনামলের শেষ দিকে কয়েকটি অঞ্চলে দুর্বলতা দেখা দেয় এবং বিচ্ছিন্ন আন্দোলন বেড়ে যায়! এরই ফলে তুর্কিদের প্রভাব অস্তিত্ব লাভ করে। এরপর ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বিস্তৃত হতে থাকে! অবশেষে হিজরি দশম (খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দী) শতাব্দীতে গোটা আরব- বিশ্বের ওপর উসমানি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই পর্যায়গুলো ইসলামিক অঞ্চল ও ভূখণ্ড সমূহ পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে বিভিন্নভাবে বহিরাগত আক্রমণের সম্মুখীন হয়! এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন এবং মারাত্মক আগ্রাসন ও আক্রমণ ছিল ক্রুসেড যুদ্ধসমূহ এবং ভয়ঙ্কর মোঙ্গল-যুদ্ধ! নিজেদের ঐক্য এবং আকিদাগত দৃঢ় বিশ্বাসের কল্যাণে মুসলমানরা এ-সব আক্রমণ ও যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় এবং আক্রমণকারীদের ওপর বিজয় লাভ করে! মুসলমানরা নিজেদের দেশ ও ভূখণ্ড থেকে আক্রমণকারীদেরকে বিতাড়িত করে।
যে-বিষয়টি বোঝা এবং উপলব্ধি করা উচিত, তা হলো, মুসলমানরা নিজেদের বিজিত দেশ ও অঞ্চল সমূহে যোদ্ধা এবং দখলদার হিসেবে প্রবেশ করেনি! বরং তারা এ-সব দেশে প্রবেশ করেছিলো ইসলামের শাশ্বত বার্তা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের সৈনিক হিসেবে! বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর জাগরণে কিংবা পুনর্জাগরণে বিরাট ভূমিকা রাখে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি! ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর পুনর্জাগরণে ইসলাম ধর্মের অবদান ছিল অনস্বীকার্য! আন্দালুস এবং সিসিলির মারকায সমূহ থেকে ইসলামি সভ্যতা ইউরোপে প্রবেশের পূর্বে এই অঞ্চলের জনগণ ছিল মধ্যযুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত।
মোটকথা, ইসলামের ইতিহাস একটি আয়না এবং একটি পাঠশালার মতো যাতে রয়েছে অনেক বীরত্ব, মহত্ত্ব ও কীর্তিগাথা – যেগুলো নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি! ইসলামি ইতিহাসের ঐতিহ্য ও নিদর্শন গুলোর জন্য আমরা নিজেদের গৌরবান্বিত ও সম্মানিত মনে করি! যে-সব নিদর্শন আজও জীবন্ত ছবির মতো ইসলামি সভ্যতার গৌরবগাথা বর্ণনা করছে।
মহান আল্লাহর কাছে আমরা মিনতি করছি, তিনি যেন আমাদের এই ইতিহাস লেখার কাজকে শুধু তার সন্তুষ্টিতে পরিণত করেন–এই আশায় আমরা তাঁর কাছে দুআ করছি! তিনি উম্মতের সন্তানদের মাঝে জ্ঞানের প্রচার-প্রসারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে এই গ্রন্থ প্রকাশের তাওফিক দিয়েছেন! আল্লাহ সমস্ত শুভ ইচ্ছার উদ্ভাবক এবং তিনিই সর্বোত্তম সাহায্যকারী।