অযুর দোয়া ও ওযু করার নিয়ম. ওযুর ফরজ ও অজু ভঙ্গের কারণ কয়টি?

অযুর-দোয়া-ও-ওযু-করার-নিয়ম-কি-ওযুর-ফরজ-ও-ওযু-ভঙ্গের-কারণ-কয়টি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে অযুর দোয়া, ওযু করার নিয়ম, ওযুর ফরজ কয়টি, ওযুর সুন্নত, ওযু ভঙ্গের কারণ এবং অযু সংক্রান্ত আরো অনেক কিছু।

অযু অর্থ কি

ওযু শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উত্তমতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। অযু হল ইসলামের বিধান অনুসারে দেহের বিশেষ অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের একটি পন্থার নাম।

অযুর দোয়া

অযু করার পূর্বে ’বিসমিল্লাহ’ বলা আবশ্যক। আৰু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত হবে না ওযূ ছাড়া এবং ওযূ হবে না বিসমিল্লাহ বলা ছাড়া। (আবু দাউদ হা/১০১; তিরমিযী হা/২৫)। উল্লেখ্য যে, শুধু বিসমিল্লাহ বলতে হবে, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বা অন্য কোন দোয়া পড়া যাবে না। কারন সেগুলোর কোন দলিল কুরআন বা হাদিসে নেই।

অযুর পূর্বে নিয়তের প্রচলিত শব্দ তথা (নাওয়াইতুয়ান ……) বলা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং এটি পড়া বিদআত।

অযুতে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ধৌত করার সময় প্রচলিত বিভিন্ন দোয়া যেমন (আল্লাহুম্মাগফিরলি জামবি ……) পাঠ করা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং এটি পড়া বিদআত।

অযুর পর দোয়া পড়া সুন্নাত। দোয়াটি নিম্নরূপ:-

অযুর দোয়া আরবি

أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُه، اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ

অযুর দোয়া বাংলা উচ্চারণ

আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। আল্লাহুম্মাঝআলনি মিনাত তাউয়্যাবিনা ওয়াঝআলনি মিনাল মুতাত্বাহ্‌হিরিন।

অযুর দোয়া বাংলা অনুবাদ

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শারীক নেই; আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও তাঁরই রাসূল; হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।

অযুর দোয়ার ফজিলত

حَدَّثَنَا جَعْفَرُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ عِمْرَانَ الثَّعْلَبِيُّ الْكُوفِيُّ، حَدَّثَنَا زَيْدُ بْنُ حُبَابٍ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ صَالِحٍ، عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ يَزِيدَ الدِّمَشْقِيِّ، عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ الْخَوْلاَنِيِّ، وَأَبِي، عُثْمَانَ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ قَالَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ ‏”‏ ‏.‏

قَالَ أَبُو عِيسَى وَفِي الْبَابِ عَنْ أَنَسٍ وَعُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ عُمَرَ قَدْ خُولِفَ زَيْدُ بْنُ حُبَابٍ فِي هَذَا الْحَدِيثِ ‏.‏ قَالَ وَرَوَى عَبْدُ اللَّهِ بْنُ صَالِحٍ وَغَيْرُهُ عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ صَالِحٍ عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ يَزِيدَ عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ عَنْ عُمَرَ ‏.‏ وَعَنْ رَبِيعَةَ عَنْ أَبِي عُثْمَانَ عَنْ جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ عَنْ عُمَرَ ‏.‏ وَهَذَا حَدِيثٌ فِي إِسْنَادِهِ اضْطِرَابٌ وَلاَ يَصِحُّ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي هَذَا الْبَابِ كَبِيرُ شَيْءٍ ‏.‏ قَالَ مُحَمَّدٌ وَأَبُو إِدْرِيسَ لَمْ يَسْمَعْ مِنْ عُمَرَ شَيْئًا ‏.‏

উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযূ করার পর বলেঃ ”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শারীক নেই; আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও তাঁরই রাসূল; হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর”, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। সে নিজ ইচ্ছামত যে কোন দরজা দিয়েই তাতে যেতে পারবে।

তিরমিজি হাদিস নং ৫৫

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

উল্লেখ্য যে, এই দো’আ পাঠের সময় আসমানের দিকে তাকানোর হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ।

নাছিরুদ্দীন আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৫ পৃঃ।

ওযুর নিয়ত

ইবাদাতের একটি শর্ত হলো শুদ্ধ নিয়ত। মহান আল্লাহ বলেন, তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে; এটাই সঠিক ধর্ম। (সূরা আল বাইয়্যিনাহ আয়াত নং ৫)

নিয়ত মানে হচ্ছে মনের সংকল্প। আর তার স্থান হল অন্তর; মুখ নয়। মহানবী সঃ ও তার সাহাবীদের কেউই নিয়তের জন্য কোন নির্দিষ্ট শব্দ মুখে উচ্চারণ করতেন না; তাই তা মুখে উচ্চারণ করা বিদআত; তাছাড়া নিয়তের জন্য কোন বাধা-ধরা শব্দাবলীও নেই; যেকোন ইবাদাতের জন্য মনে মনে সংকল্প করলেই নিয়ত হয়ে যাবে। মুখে কিছু উচ্চারণের প্রয়োজন নেই। আর শুদ্ধ নিয়ত হচ্ছে এই যে, মনে মনে সংকল্প করা যে আমি এখন এই কাজটি করছি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। অতএব অযুর নিয়ত হবে এমন যে, অন্তরে সংকল্প করতে হবে যে আমি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে অযু করছি। মুখে কিছু বলতে হবে না কেবল অন্তরে এই সংকল্প করে বিসমিল্লাহ বলে অযু শুরু করতে হবে।

ওযু করার নিয়ম

(১) প্রথমে মনে মনে ওযূর নিয়ত করবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১)

(২) ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০২)

(৩) ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাত কব্জি সমেত ধুবে (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, নায়লুল আওতার ১/২০৬ ও ২১০ পৃঃ) এবং আঙ্গুল সমূহ খিলাল করবে। (নাসাঈ, আবূদাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০৫) আঙ্গুলে আংটি থাকলে নাড়াচাড়া করে সেখানে পানি প্রবেশ করাবে। (বুখারী, নায়লুল আওতার ১/২৩১ পৃঃ; ‘আংটি নাড়াচাড়া ও আঙ্গুল সমূহ খিলাল করা’ অনুচ্ছেদ)

(৪) ডান হাতে পানি নিয়ে ভালভাবে কুলি করবে ও প্রয়োজনে নতুন পানি নিয়ে নাকে দিয়ে বাম হাত দ্বারা ভালভাবে নাক ঝাড়বে। (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪)

(৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতী হয়ে থুৎনির নীচ পর্যন্ত পুরা মুখমণ্ডল ধৌত করবে (মুত্তাফাক আলাইহ, নায়লুল আওতার ১/২১০ পৃঃ) ও দাড়ি খিলাল করবে। (তিরমিযী, নায়লুল আওতার ১/২২৪ পৃঃ)

(৬) প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই সহ ধুবে (বুখারী, নায়লুল আওতার ১/২২৩ পৃঃ)

(৭) পানি নিয়ে দু’হাতের ভিজা আঙ্গুলগুলি মাথার সম্মুখ হতে পিছনে ও পিছন হতে সম্মুখে বুলিয়ে একবার পুরা মাথা মাসাহ করবে। (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪) একই সাথে ভিজা শাহাদত আঙ্গুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আঙ্গুল দ্বারা পিছন অংশে মাসাহ করবে। (নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৪)

(৮) ডান ও বাম পায়ের টাখনুসহ ভালভাবে ধুবে (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪) ও বাম হাতের আঙ্গুল দ্বারা পায়ের আঙ্গুল সমূহ খিলাল করবে। (আবূদাউদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৪০৬-০৭)

(৯) এভাবে ওযূ শেষে বাম হাতে কিছু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিবে (আবূদাউদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৬১) ও উপরোক্ত দোয়া পাঠ করবে।

ওযুর ফরজ কয়টি ও কী কী

ওযূর ফরয চারটি যা আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন। তা হল :

১. সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল ধৌত করা

আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে মুমিনগণ! যখন তোমরা ছালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ধৌত কর’ (মায়েদা ৫/৬)।

কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া মুখমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। অতএব কেউ যদি মুখমণ্ডল ধৌত করে কিন্তু কুলি না করে অথবা নাকে পানি না দেয়, তাহলে তার ওযূ ছহীহ হবে না। কারণ আল্লাহ তা’আলা সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল ধোয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া মুখমণ্ডল ধোয়ার অন্তর্ভুক্ত।

ছালেহ আল-ফাউযান, আল-মুলাক্ষাছুল ফিকহী ১/৪১ পৃঃ; আল-ফিকহুল মুয়াস্সার ১৮ পৃঃ।

২. উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা তোমাদের হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত কর। (মায়েদা ৫/৬)। এখানে কনুই পর্যন্ত বলতে কনুই সহ ধৌত করার কথা বলা হয়েছে।

জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ওযূ করতেন তখন তাঁর দুই কনুইয়ের উপর পানি ঢেলে দিতেন।

দারাকুতনী হা/২৮০; সিলসিলা ছহীহা হা/২০৬৭।

অন্য হাদীছে এসেছে

নু‘আঈম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মুজমির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে ওযূ করতে দেখেছি। তিনি খুব ভালভাবে মুখমণ্ডল ধৌত করলেন, এরপর ডান হাত বাহুর কিছু অংশসহ ধৌত করলেন। পরে বাম হাতও বাহুর কিছু অংশসহ ধৌত করলেন। এরপর মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর ডান পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধৌত করলেন। তারপর বাম পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধৌত করলেন। অতঃপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)- কে এভাবে ওযূ করতে দেখেছি।

মুসলিম হা/২৪৬, ‘ওযূর সময় মুখমণ্ডল, কনুই ও পায়ের টাখনুর বাইরে একটু বেশী করে ধোয়া উত্তম’ অনুচ্ছেদ।

এ হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, উভয় হাতের কনুই ও পায়ের গোড়ালী সহ ধৌত করতে হবে।

৩. সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা

আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা তোমাদের মাথা মাসাহ কর। (মায়েদা ৫/৬)।

এখানে মাথা মাসাহ বলতে সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করার কথা বলা হয়েছে। অতএব মাথার কিছু অংশ মাসাহ করা বৈধ নয়। হাদীছে এসেছে,

অতঃপর তিনি দু’হাত দিয়ে মাথা মাসাহ করলেন। অর্থাৎ হাত দু’টি সামনে এবং পেছনে নিলেন। মাথার সম্মুখভাগ থেকে শুরু করে উভয় হাত পেছনের চুলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিলেন। তারপর আবার যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে আনলেন।

বুখারী হা/১৮৫, ‘ওযূ’ অধ্যায়, ‘পূর্ণ মাথা মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/১০৭ পৃঃ; মুসলিম হা/২৩৫; মিশকাত হা/৩৯৩, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৭৮ পৃঃ।

মাথা মাসাহ করার সাথে একই পানি দিয়ে কান মাসাহ করতে হবে। কারণ কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কানদ্বয় মাথার অংশ।

ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩; আবুদাউদ হা/১৩৪; সিলসিলা ছহীহা হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪।

অতএব যেহেতু কান মাথার অংশ সেহেতু মাথার সাথে কান মাসাহ করাও ফরয।

৪. টাখনু পর্যন্ত উভয় পা ধৌত করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা তোমাদের পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত কর। (মায়েদা ৫/৬)।

এখানে টাখনু পর্যন্ত বলতে টাখনুসহ ধৌত করা বুঝানো হয়েছে। যেমন পূর্বোক্ত হাদীছ- আবু হুরায়রাহ ডান পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধৌত করলেন।

অতঃপর বাম পায়ের নলার কিছু অংশসহ ধৌত করলেন। এরপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এভাবে ওযূ করতে দেখেছি।

মুসলিম হা/২৪৬

উপরিউক্ত ওযূর চারটি ফরয ছাড়াও আরো দু’টি কাজ অপরিহার্য

এমনকি ফকীহগণের অনেকেই এ দু’টিকেও ফরযের মধ্যে গণ্য করেছেন।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/১৮৩ পৃঃ; ছালেহ আল-ফাউযান, আল- মুলাক্ষাছুল ফিকহী ১/৪১ পৃ।

তবে এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

১. ওযূ করার সময় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা

অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল, তারপর দুই হাত ধৌত করা, অতঃপর মাথা মাসাহ করা এবং শেষে দুই পা ধৌত করা। যেভাবে পবিত্র কুরআনে এসেছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ! যখন তোমরা ছালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত কর’ (মায়েদা ৫/৬)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ওযূর যে ধারাবাহিকতা বর্ণনা করেছেন তা বজায় রাখা অপরিহার্য। কেননা আল্লাহ তা’আলা কনুই পর্যন্ত হাত এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত করার মাঝখানে মাথা মাসাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অপরিহার্য না হত, তাহলে তিনি হাত ও পা ধৌত করার মাঝখানে মাথা মাসাহ করার নির্দেশ দিতেন না। হয় মাথা মাসাহ করার নির্দেশ ধৌত করা অঙ্গ সমূহের আগে বা পরে দিতেন। এছাড়াও ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কিত প্রত্যেক হাদীছেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/১৮৯-১৯০ পৃঃ।

অতএব মুখমণ্ডলের পূর্বে হাত কিংবা হাতের পূর্বে পা ধৌত করলে ওযূ ছহীহ হবে না।

২. ওযূ করার সময় এক অঙ্গ শুকানোর পূর্বেই অপর অঙ্গ ধৌত করা

খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর কতিপয় ছাহাবী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, তিনি ছালাত আদায় করছেন, কিন্তু তার পায়ের পাতায় এক দিরহাম পরিমাণ জায়গা শুকনো দেখতে পেলেন, যেখানে পানি পৌঁছেনি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিলেন।

আবু দাউদ হা/১৭৫; আলবানী, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল ১/১২৭।

অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এক অঙ্গ শুকানোর পূর্বেই অপর অঙ্গ ধৌত করা অপরিহার্য। যদি অপরিহার্য না হত তাহলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছে উল্লেখিত ব্যক্তিকে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন না। বরং তার পায়ের যতুটুকু জায়গা শুকনো ছিল ততটুকুই ধৌত করার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু যেহেতু তার অন্যান্য অঙ্গ শুকিয়ে গিয়েছিল সেহেতু তাকে পুনরায় অযু করার নির্দেশ দিয়েছেন।

ওযুর সুন্নত কয়টি

(ক) মিসওয়াক করে ওযূ আরম্ভ করা সুন্নাত

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যদি আমি আমার উম্মতের উপর কঠিন মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক ওযূর সাথে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।

বুখারী, ‘ছায়েমের জন্য কাঁচা বা শুকনো মিসওয়াক ব্যবহার করা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/৩০৮ পৃঃ।

(খ) বিসমিল্লাহ বলে ওযূ আরম্ভ করা সুন্নাত

আৰু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত হবে না ওযূ ছাড়া এবং ওযূ হবে না বিসমিল্লাহ বলা ছাড়া।

আবু দাউদ হা/১০১; তিরমিযী হা/২৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯; মিশকাত হা/৪০২, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৮২ পৃঃ। আলবানী, সনদ ছহীহ।

অত্র হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করে কিছু সংখ্যক আলেম বলেন যে, বিসমিল্লাহ বলে ওযূ আরম্ভ করা ওয়াজিব। তবে ছহীহ মত হল, বিসমিল্লাহ বলে ওযূ আরম্ভ করা সুন্নাত।

ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/১২২ পৃঃ।

কেননা যে হাদীছগুলোতে রাসূল (ছাঃ)-এর ওযূর পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে তাতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার কথা বলা হয়নি। তাছাড়া ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ওযূ আরম্ভ করা ওয়াজিব মর্মে ভাল সনদের কোন হাদীছ আমার জানা নেই।

ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ১/১৪৫ পৃঃ।

(গ) ঘুম থেকে জেগে ওযূ করার পূর্বে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করা সুন্নাত

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ওযূ করে তখন সে যেন তার নাক পানি দিয়ে ঝাড়ে। আর যে শৌচকার্য করে সে যেন বেজোড় সংখ্যক ঢিলা ব্যবহার করে। আর তোমাদের কেউ যখন ঘুম থেকে জাগে তখন সে যেন ওযূর পানিতে হাত ঢুকানোর পূর্বে তা ধুয়ে নেয়। কারণ তোমাদের কেউ জানে না যে, ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত কোথায় থাকে।

বুখারী হা/১৬২, ‘বেজোড় সংখ্যক ঢিলা ব্যবহার করা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/৯৬ পৃঃ; মুসলিম হা/২৭৮; মিশকাত হা/৩৯১, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৭৭ পৃঃ।

(ঘ) নাকের ভিতরে পানি প্রবেশ করিয়ে তা ঝেড়ে ফেলা সুন্নাত

তবে ছিয়াম অবস্থায় নাকের এমন গভীরে পানি প্রবেশ করানো যাবে না। যাতে পেটের মধ্যে পানি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে।

আছেম ইবনে লাক্কীত ইবনে ছাবিরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা নাসিকায় পানি প্রবেশ করাও। তবে ছিয়াম অবস্থা ছাড়া।

আবু দাউদ হা/২৩৬৬; তিরমিযী হা/৭৮৮; নাসাঈ হা/৮৭; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭; আলবানী, সনদ ছহীহ।

(ঙ) ওযূর অঙ্গ সমূহ পানি দিয়ে মর্দন করা সুন্নাত

আব্বাদ ইবনে তামীম তার চাচা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ওযূ করতে দেখেছি, তিনি তাঁর হাত মর্দন করলেন।

ছহীহ ইবনে হিব্বান হা/১০৮২; মুসতাদরাক হাকেম হা/৫০৯; আরনাউত, সনদ ছহীহ।

(চ) দাড়ি খিলাল করা সুন্নাত

দাড়ি দুই প্রকার। ১- পাতলা দাড়ি যার ভিতর দিয়ে চামড়া দেখা যায়। এই দাড়ি ধৌত করা ওয়াজিব। ২- ঘন দাড়ি যার ভিতর দিয়ে চামড়া দেখা যায় না । এই দাড়ি ধৌত করা ওয়াজিব নয়। বরং পানি দিয়ে খিলাল করা সুন্নাত।

আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)- কে তাঁর দাড়ি খিলাল করতে দেখেছি।

তিরমিযী হা/২৯; ইবনু মাজাহ হা/৪২৯; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অন্য হাদীছে এসেছে,

আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ওযূ করতেন তখন হাতের এক অঞ্জলী পানি নিতেন এবং তাঁর চোয়ালের নিচে প্রবেশ করাতেন। অতঃপর তা দ্বারা তাঁর দাড়ি খিলাল করতেন এবং তিনি বলতেন, “আল্লাহ তা’আলা আমাকে অনুরূপ নির্দেশ দিয়েছেন।

আবুদাউদ হা/১৪৫, মিশকাত হা/৪০৮, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৮৩ পৃঃ; আলবানী, সনদ ছহীহ।

(ছ) হাত ধোয়ার সময় প্রথমে ডান হাত এবং পা ধোয়ার সময় প্রথমে ডান পা ধৌত করা সুন্নাত

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) নিজের সমস্ত কাজে যথাসম্ভব ডান দিক হতে আরম্ভ করা পসন্দ করতেন। পবিত্রতা অর্জন, মাথা আচড়ানো এবং জুতা পরার সময়ও।

বুখারী হা/৪২৬, ‘মসজিদে প্রবেশ ও অন্যান্য কাজ ডান দিক হতে আরম্ভ করা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/২১৭ পৃঃ; মুসলিম হা/২৬৮; মিশকাত হা/৪০০, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/৮১ পৃঃ।

(জ) ওযূর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ দ্বিতীয় বার ও তৃতীয় বার ধৌত করা সুন্নাত

তবে প্রথম বার ধৌত করা ওয়াজিব।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) ওযূর অঙ্গ একবার করে ধৌত করেছেন।

বুখারী হা/১৫৭

অন্য হাদীছে এসেছে,

আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ বলেন, নবী করীম (ছাঃ) ওযূর অঙ্গ দু’বার করে ধৌত করেছেন।

বুখারী হা/১৫৮

অন্য হাদীছে এসেছে,

হুমরান (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি ওছমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ)-কে দেখেছেন যে, তিনি পানির পাত্র আনিয়ে উভয় হাতের তালুতে তিনবার ঢেলে তা ধুয়ে নিলেন। অতঃপর ডান হাত পাত্রের মধ্যে ঢুকালেন। তারপর কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। তারপর তাঁর মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করলেন এবং দু’হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করলেন। অতঃপর মাথা মাসাহ করলেন। অতঃপর দুই পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধৌত করলেন। পরে বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম ওযূ করবে, অতঃপর দু’রাক’আত ছালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

বুখারী হা/১৫৯

অতএব উল্লিখিত দলীল সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ওযূতে প্রথমবার ধৌত করা ওয়াজিব এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ধৌত করা সুন্নাত। তবে মাথা শুধুমাত্র একবার মাসাহ করতে হবে।

(ঝ) ওযু শেষে দো’আ পড়া সুন্নাত

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মুসলমানদের যে কেউ ওযূ করবে, সে যেন উত্তমভাবে ওযূ করে। অতঃপর বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহ্ বান্দা ও তাঁর রাসূল। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। সে যেকোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।

মুসলিম হা/২৩৪; ইবনু মাজাহ হা/৪৭০

ওযু ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কি কি

ওযু ভঙ্গের কারণ মোট ৫টি। যথা:

১. পেশাব ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে কিছু বের হওয়া

পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে মল-মূত্র, বীর্য, মযী, হায়েয ও নিফাসের রক্ত এবং বায়ু বের হলে ওযু ভঙ্গ হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, অথবা তোমাদের কেউ পেশাব-পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রী সম্ভোগ কর, তবে যদি পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।

সূরা নিসা: ৪৩

রাসুল সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তির ওযু ভঙ্গ হয়েছে তার ছালাত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওযূ না করে।

বুখারী হা/১৩৫

অন্য হাদীছে এসেছে,

সাফওয়ান ইবনে আসসাল রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, আমরা যেন (সফর অবস্থায়) তিন দিন যাবৎ পেশাব-পায়খানা এবং ঘুমের কারণে আমাদের মোযা না খুলি। তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।

তিরমিযী হা/৯৬; ইবনু মাজাহ হা/৪৭৮; মিশকাত হা/৫২০

অন্য হাদীছে এসেছে,

আব্বাদ ইবনু তামীম (রহঃ)-এর চাচা হতে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হল যে, তার মনে হয়েছিল যেন ছালাতের মধ্যে কিছু হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, ‘সে যেন ফিরে না যায়, যতক্ষণ না শব্দ শুনে বা দুর্গন্ধ পায়।

বুখারী হা/১৩৭, মুসলিম হা/৩৬১; মিশকাত হা/৩০৬।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি ইস্তিহাযাগ্রস্ত মহিলা ছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, হায়েযের রক্তের পরিচিতি এই যে, তা কাল রং-এর হবে। যখন এই ধরনের রক্ত প্রবাহিত হবে তখন ছালাত ত্যাগ করবে এবং যখন অন্যরূপ রং দেখবে তখন ওযূ করে ছালাত আদায় করবে। নিশ্চয়ই এটা হচ্ছে রগের রক্ত।

আবু দাউদ হা/২৮৬; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অতএব বুঝা গেল, পেশাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোন কিছু বের হলেই ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে ।

পক্ষান্তরে শরীরের যেকোন স্থান দিয়ে রক্ত, পুঁজ বের হলে এবং বমন হলে ওযূ ভঙ্গ হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হল, উল্লিখিত কারণে ওযূ ভঙ্গ হবে না। তবে রক্ত, পুঁজ এবং বমনের পরিমাণ খুব বেশী হলে মতভেদের গণ্ডি হতে নিজেকে দূরে রাখার জন্য পুনরায় ওযূ করাই ভাল।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/২৭৪ পৃঃ; মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল- ফাওযান, আল-মুলাক্ষাছুল ফিক্বহী ১/৬১ পৃঃ।

২. শরীরের যেকোন অঙ্গ থেকে নাপাকি বের হওয়া

অপারেশন করে পাইপের মাধ্যমে প্রস্রাব-পায়খানা বের করলে বা শরীরের কোন ক্ষতস্থান থেকে বেশি পরিমাণ রক্ত, বা পুঁজ বের হলে বা বমি করলে ওযু ভঙ্গ হয়ে যায়। (ফাতাওয়া বিন বায ৩/২৯৪)

৩. জ্ঞান হারিয়ে ফেলা

অস্থায়ী জ্ঞান হারানো, যা ঘুম, অসুস্থতা এবং নেশাগ্রস্তের কারণে হয়ে থাকে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিতেন,

আমরা যেন (সফর অবস্থায়) তিন দিন যাবৎ পেশাব-পায়খানা এবং ঘুমের কারণে আমাদের মোযা না খুলি । তবে জানাবাতের অবস্থা ব্যতীত।

তিরমিযী হা/৯৬; ইবনু মাজাহ হা/৪৭৮; মিশকাত হা/৫২০, ‘মোজার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/১৩১ পৃঃ; আলবানী, সনদ হাসান ।

অন্য হাদীছে এসেছে,

আলী ইবনু আবু তালেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘চক্ষু হল গুহ্যদ্বারের ঢাকনা । অতএব যে ব্যক্তি ঘুমাবে সে যেন ওযূ করে।

আবুদাউদ হা/২০৩; ইবনু মাজাহ হা/৪৭৭; আলবানী, সনদ হাসান। দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হা/১১৩।

এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ওযূ অবস্থায় ঘুমিয়ে গেলে ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায়। তবে তা এমন ঘুম যে, ঘুমের মধ্যে বায়ু নিঃসরণ হলে তা উপলব্ধি করা যায় না। পক্ষান্তরে যদি এমন ঘুম হয় যে ঘুমে বায়ু নিঃসরণ উপলব্ধি করা যায় সে ঘুমের কারণে ওযূ ভঙ্গ হবে না।

মাজমূ’ ফাতাওয়া ২১/২৩০ পৃঃ।

এ প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে,

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ এশার ছালাতের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি (ঘুমের কারণে) তাদের মাথা আন্দোলিত হচ্ছিল। অতঃপর তারা ছালাত আদায় করলেন। কিন্তু ওযূ করলেন না।

আবূ দাউদ হা/২০০; মিশকাত হা/৩১৭

৪. স্থায়ীভাবে জ্ঞান হারানো

যা পাগল হয়ে গেলে হয়ে থাকে। অস্থায়ীভাবে জ্ঞান হারালে যেহেতু ওযূ ভঙ্গ হয়ে যায় সেহেতু স্থায়ীভাবে জ্ঞান হারালেও ওযূ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৫. উটের গোশত খাওয়া

জাবের ইবনু সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি কি ছাগলের গোশত খেয়ে ওযূ করব? তিনি বললেন, ‘তুমি চাইলে ওযূ কর। আর না চাইলে ওযূ কর না। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি উটের গোশত খেয়ে ওযূ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, উটের গোশত খেয়ে ওযূ করবে।

মুসলিম হা/৩৬০; মিশকাত হা/৩০৫

৬. নামাজে উচ্চস্বরে হাসা

ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজে উচ্চস্বরে হাসে, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করবে। হাসান বিন কুতাইবা (রহ.) বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি উচ্চস্বরে হাসি দেয়, সে ব্যক্তি অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করবে।’ (সুনানে দারা কুতনি, হাদিস : ৬১২)

৭. গোসল ফরয হয় এমন কিছু ঘটে যাওয়া

যেসব কারণে গোসল ফরয হয় সেসব ঘটনায় ওযূও ভঙ্গ হয়ে যায় ।

লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে কি?

এখানে লজ্জাস্থান বলতে পেশাব-পায়খানা উভয় দ্বারকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি কেউ ওযূ অবস্থায় পেশাব-পায়খানার রাস্তা সরাসরি স্পর্শ করে তাহলে তার ওযু ভঙ্গ হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হল উত্তেজনা ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে না। কিন্তু উত্তেজনা বশত স্পর্শ করলে এবং লজ্জাস্থান দিয়ে কিছু নির্গত হলে ওযূ ভঙ্গ হবে।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/২৮৪ পৃঃ; মুহাম্মাদ ইবনে ওমর ইবনে সালেম বাযেমূল, আত-তারজীহু ফী মাসায়েলিত ত্বাহারাহ ওয়াছ ছালাত, ৬০ পৃঃ।

কায়েস ইবনে তুলক তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আমরা আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর নিকট গমন করি। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্র রাসূল! ওযূ করার পরে যদি কোন ব্যক্তি তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করে তবে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘পুরুষাঙ্গ তো একটি গোশতের টুকরা অথবা তিনি বললেন, গোশতের খণ্ড মাত্র।

আবু দাউদ হা/১৮২; তিরমিযী হা/৮৫; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে না। লজ্জাস্থান শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতই। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ স্পর্শ করলে যেমন ওযূ ভঙ্গ হবে না, তেমনি লজ্জাস্থান স্পর্শ করলেও ওযূ ভঙ্গ হবে না।

পক্ষান্তরে অন্য হাদীছে এসেছে,

বুসরা বিনতে ছাফওয়ান হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাঃ কে বলতে শুনেছেন, যে তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে।

আবু দাউদ হা/১৮১; তিরমিযী হা/৮২; নাসাঈ হা/১৬৩; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে লোক তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে, আর যে মহিলা তার লজ্জাস্থান স্পর্শ করল সে যেন ওযূ করে।

মুসনাদে আহমাদ হা/৭০৭৬; আলবানী, সনদ ছহীহ; দ্র: ছহীহুল জামে আছ-ছাগীর হা/২৭২৫।

উল্লিখিত হাদীছদ্বয় দ্বারা লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ করা মুস্তাহাব বুঝানো হয়েছে; ওয়াজিব বুঝানো হয়নি। উপরোক্ত প্রথম হাদীছ যার প্রমাণ বহন করে। কেননা উক্ত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘পুরুষাঙ্গ তো একটি গোশতের টুকরা অথবা তিনি বললেন, গোশতের খণ্ড মাত্র।

আবু দাউদ হা/১৮২; তিরমিযী হা/৮৫; আলবানী, সনদ ছহীহ।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়।

মাজমূ’ ফাতাওয়া ২১/২৪১ পৃঃ।

তাছাড়া আলী ইবনু আবি তালেব (রাঃ), আম্মার ইবনু ইয়াসার (রাঃ), ইবনে মাস’ঊদ (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ), ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ), আবু দারদা (রাঃ), কায়েস ইবনু তালক (রাঃ), ইবনে জুবাইর (রাঃ), নাখঈ এবং তাউস (রহঃ) সকলেই লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না বলে উল্লেখ করেছেন।

মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক ১/১১৭-১২১ পৃঃ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ১/১৬৪-১৬৫ পৃঃ।

নারীদের স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে কি?

ওযূ অবস্থায় নারীদের স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে কি-না এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে বিশুদ্ধ মত হল ওযূ অবস্থায় নারীদের স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/২৯১ পৃঃ; আত-তারজীহু ফী মাসায়েলিত ত্বাহারাহ ওয়াছ ছালাত ৬১-৬৭ পৃঃ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

হে মুমিনগণ! যখন তোমরা ছালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর) এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রীদের স্পর্শ কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তা দ্বারা তোমাদের মুখ ও হাত মাসাহ কর। (মায়েদা ৫/৬)।

এই আয়াতে উল্লেখিত স্পর্শ বলতে স্ত্রী সহবাসের কথা বুঝানো হয়েছে। শুধুমাত্র হাত দ্বারা স্পর্শ করা বুঝানো হয়নি।

তাফসীরুত ত্ববারী, (দারুল ফিকর) ৫/১০৫ পৃঃ।

এছাড়াও হাদীছে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর কতিপয় স্ত্রীকে চুম্বন করলেন। অতঃপর ছালাতের জন্য বের হয়ে গেলেন কিন্তু ওযূ করলেন না। আমি বললাম (উরওয়া ইবনে জুবাইর), সেটা আপনি ছাড়া আর কে? তখন তিনি (আয়েশা) হাসতে লাগলেন।

তিরমিযী হা/৮৬; ইবনু মাজাহ হা/৫০২; আলবানী, সনদ ছহীহ।

অতএব ওযূ অবস্থায় নারী স্পর্শ করলে বা চুম্বন করলে ওযূ ভঙ্গ হবে না ।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে অথবা কোন অপবিত্র বস্তু স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে না।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া, হাক্বীকাতুছ ছিয়াম ৪৪ পৃঃ।

মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযু ভঙ্গ হবে কি?

ওযূ অবস্থায় মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযূ ভঙ্গ হবে না। কারণ মৃত ব্যক্তিকে গোসল করালে ওযু ভঙ্গ হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত নয়।

পক্ষান্তরে ইবনু ওমর (রাঃ), আবু হুরায়রাহ (রাঃ) এবং ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে একটি আছার বর্ণিত হয়েছে যেখানে তাঁরা মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর পরে ওযূ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৬১০১।

অত্র আছার দ্বারা ওযূ ভঙ্গ হওয়ার কথা বুঝানো হয়নি। বরং মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর পরে ওযূ করা মুস্তাহাব বুঝানো হয়েছে।

মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে ১/২৯৬ পৃঃ।

FAQ

উলংগ হলে কি ওযু ভাঙ্গে

উলঙ্গ হওয়া অজু ভঙ্গের কোন কারণের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাই সতর খুলে ফেলার দ্বারা অজু ভঙ্গ হবে না।

গান শুনলে কি ওযু ভাঙ্গে

গান শুনলে অযু ভাঙ্গে না। তবে গান শোনা হারাম যদি তা হয় অসার অশ্লীল, শিরক এবং বিদআতযুক্ত অথবা যদি তা হয় বাজনা যুক্ত তা যতই ভাল ও তাওহীদমূলক হোক না কেন।

গালি দিলে কি ওযু ভাঙ্গে

গালি দিলে ওযু ভাঙ্গে এমন কোন কথা কুরআন বা হাদিসে নেই তবে গালি দেওয়া হারাম।

খাবার খেলে কি ওযু ভাঙ্গে

খাবার খেলে ওযু ভাঙ্গে না।

ওযু শব্দের অর্থ কি

ওযু শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উত্তমতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা।

মাথায় কাপড় না দিলে কি ওযু ভেঙে যায়

মাথায় কাপড় না দিলে কি ওযু ভাঙ্গে না।

মন্তব্য করুন